
সবুজে আচ্ছাদিত গ্রামটির নাম চরপাতা। আয়তনে বিশাল। ভাগ হয়ে পূর্ব-পশ্চিম নাম ধারণ করেছে। নামকরণে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে রায়পুর-চাঁদপুর আঞ্চলিক মহাসড়কটি। এটি গ্রামের বুক চিরে এঁকেবেঁকে ছুটে গিয়ে মিলিত হয়েছে চাঁদপুর শহরে। বছর ত্রিশেক আগেও রাস্তাটি ছিল কাঁচা। রাস্তার দুই ধারে দাঁড়িয়েছিল বেশকিছু মোটাসোটা গাছ। তন্মধ্যে রেইনট্রি গাছ ছিল বেশি। ছিল বট-পাকুড় গাছও। এখন নেই। তো তেমনি দুটি পাকুড় গাছ ছিল ‘সিংহপুল’ নামক স্থানে। বিকেলে গ্রামের ছেলে-বুড়োরা সিংহপুলে এসে আড্ডা জমাতেন। কিশোর ছিলাম তখন আমি। তথাপিও যেতাম সেখানে মাঝেমধ্যে। আড্ডা দিতে নয়। পাকুড় ফল খেতে আসা হলুদাভ সবুজ রঙের পাখিগুলোকে একনজর দেখতে। প্রত্যহ গাছে একঝাঁক পাখি দেখা যেত পাকুড় পাকলে। দৃশ্যটি ছিল ভারি চমৎকার। গ্রামের প্রত্যেকেই উপভোগ করতেন সেটি। তাই বড়রা ওদের কখনো বিরক্ত করেননি।
পাখিগুলো দেখতে অনেকটা কবুতরের মতো হলেও সৌন্দর্য বিচারে কবুতরের চেয়ে বহুগুণ এগিয়ে। নিজচোখে না দেখলে এ পাখির রূপের বর্ণণা দেয়া খুবই কঠিন। অনেকটা ‘অন্ধের হস্তি’ দর্শনের মতো। একটা সময় দেশের গ্রামগঞ্জে সুলভ দর্শন ছিল এ পাখি। নির্জন কোনো জঙ্গলে অথবা ছোট পাকা ফলবান বৃক্ষের নিচে গেলে ওদের সাক্ষাৎ পাওয়া যেত। বর্তমানে খুব একটা নজরে পড়ছে না। ব্যাপকহারে ফলবান বৃক্ষ নিধনের ফলে এরা খাদ্য সংকটে পড়েছে। ব্যাহত হচ্ছে প্রজননেও। এ পাখি আজ অসুলভ দর্শন হয়ে পড়েছে আমাদের দেশে। এরা আজীবন বৃক্ষচারী। জলপান ব্যতিরেকে মাটিতে নামে না খুব একটা। বিচরণ করে ঝাঁক বেঁধে। স্বভাবে শান্ত। গায়ে পড়ে অন্য প্রজাতি তো দূরের কথা নিজেদের কারো সঙ্গে পর্যন্ত ঝগড়ায় লিপ্ত হয় না।
পাখিটার বাংলা নাম: ‘হলুদ পা হরিয়াল’, ইংরেজি নাম: ‘ইএয়এলা ফুএটড গিণ্ঠন পিজিয়ন’ (Yellow Footed Green Pegion), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘ট্রেরন ফোনিকোপটেরা’ (Treron phoenicoptera), গোত্রের নাম: ‘কলাম্বিদি’। অঞ্চলভেদে এরা ‘হরিকল বা বটকল’ নামে পরিচিত।
লম্বায় এরা ৩২-৩৪ সেন্টিমিটার। হরিয়ালের গায়ের বর্ণ জলপাই সবুজের সঙ্গে ছাই-ধূসর মিশ্রণ। মাথা ধূসর। ঘাড়ে লালচে ছোপ। ডানা সবুজাভ কালোর ওপর হলদে টান। বুক এবং বুকের দুই পাশ ও বুকের নিুাংশ ধূসর। চোখের বলয় গোলাপি। পা ও আঙুল উজ্জ্বল হলুদ। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে প্রায় একই রকম। আকারে স্ত্রী পাখি সামান্য ছোট এবং গায়ের রঙ পুরুষ পাখির চেয়ে সামান্য ফিকে।
হরিয়ালের প্রধান খাদ্য ছোট ফল। বিশেষ করে বট-পাকুড় ফলের প্রতি আসক্তি বেশি। এ ছাড়া অন্যান্য ছোট ফল এদের প্রিয়। প্রজনন সময় বসন্ত থেকে গ্রীষ্মকাল। বাসা বাঁধে গাছের উঁচু শাখায় ঘনপাতার আড়ালে। ডিমপাড়ে ২টি।
লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।
সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 12/04/2013