কমলাদামা | Orange Headed Thrush | Zoothera citrina
কমলাদামা | ছবি: ইবার্ড এ পাখি আমাদের প্রতিবেশী হলেও অনেক ভীতু এবং লাজুক স্বভাবের। স্বভাবে লাজুক হলেও এরা মানুষের একেবারে কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করে। মানুষও খুব একটা ক্ষতি করে না এদের। বরং আদর করে নানা নামে ডাকে। কেউ ডাকে কমলা বউ, কেউ ডাকে কমলাফুলি, আবার অনেকেই ডাকে কমলা দোয়েল নামে। তবে ‘কমলাদামা’ নামেই এটি অধিক পরিচিত। বাংলাদেশের সর্বত্র কমলাবউ পাখির বিচরণ। কম-বেশি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে সবখানেই। এদের অধিকাংশই বিচরণ করে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে। তাই অনেকের ধারণা, কমলাবউর বাস ওই অঞ্চলেই। প্রকৃতপক্ষে তা সঠিক নয়। রাজধানীর অপেক্ষাকৃত নিরিবিলি স্থানেও এদের দেখা মেলে। বোটানিক্যাল গার্ডেনে ২০১০ সালে একবার দেখেছি। তারপর আর দেখিনি। বাসা তৈরির উপযুক্ত গাছপালার অভাবে রাজধানী থেকে এরা ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। কমলাবউর রূপ যেমন, তেমনি গুণ। বিভিন্ন ধরনের কসরত দেখাতে পটু এরা। বিশেষ করে হিংস্র পোকামাকড় কিংবা ছোট সাপের বাচ্চা শিকারের কৌশল বেশ দর্শনীয়। অনেকটা নেচে-নেচে শিকার ধরে। এ পাখির ইংরেজি নামঃ অরেঞ্জ হেডেড থ্রাস (Orange Headed Thrush), বৈজ্ঞানিক নামঃ জুথেরা সিট্রিনা (Zoothera citrina), গোত্রঃ ‘মুস্কিকাপিদি’। কমলাবউ দোয়েল আকৃতির পাখি। হাঁটেও দোয়েলের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে। ফলে অনেকে এদের ‘দোয়েল’ বলে ভুল করে। লম্বায় এরা ২০ থেকে ২২ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একরকম মনে হলেও সৌন্দর্যের দিক থেকে এগিয়ে রয়েছে পুরুষ পাখি। কমলাবউ পাখির মাথা, ঘাড়, গলা ও বুক কমলা-বাদামি। তলপেট ও লেজের নিচের দিক সাদাটে। চোখের মণি গাঢ় পিঙ্গল। চোখের নিচ বরাবর পরপর তিনটি সাদা ছোপ। পিঠের পালক নীলাভ ছাই বর্ণের। পায়ের রঙ ফিকে গোলাপি। স্ত্রী পাখির বুকের রঙ সামান্য ফিকে। পিঠের ওপরের পালক ছাই ধূসর।কমলাবউর প্রজনন সময় মার্চ থেকে মে। এ সময় স্ত্রী-পুরুষ পাখি একসঙ্গে চলাফেরা করে। অন্য সময় এরা মূলত আলাদা বাস করে। বাসা বাঁধার ব্যাপারে এরা যথেষ্ট খুঁতখুঁতে। পছন্দসই জায়গা খুঁজে পেলে তবে বাসা তৈরি করে। বাসার আদল চায়ের কাপের মতো। এমনকি চায়ের কাপের মতো হাতলও বানায়। হাতলটা দিয়ে গাছের ডালপালার সঙ্গে মজবুত করে বেঁধে রাখে। বাসা তৈরির উপকরণ শুকনো ঘাস, লতাপাতা ইত্যাদি। আর যাই হোক বাসাটা এরা খুবই সুন্দরভাবে বানাতে পারে। বাসা বানানো হলে তিন থেকে চারটি ডিম পাড়ে। স্ত্রী-পুরুষ পাখি পালা করে ডিমে তা দেয়। ডিম ফুটে বাচ্চা বেরোতে সময় লাগে ১৪-১৫ দিন। শান্ত স্বভাবের এ বাচ্চাদের স্বাবলম্বী হতে মাসখানেক লেগে যায়। তবে উড়তে শিখতে সময় নেয় ২০ দিনের মতো। তারপর মা-বাবার সঙ্গে থেকে ধীরে ধীরে শিকারের কৌশল রপ্ত করে। প্রধান খাবারঃ মূলত কীটপতঙ্গই এদের। সুযোগ পেলে কেঁচো, সাপের ছোট বাচ্চা শিকার করতে এরা পিছপা হয় না। খেজুরের রস কমলাবউর বেশ প্রিয়। রসের স্বাদ নিতে প্রায়ই খেজুর গাছের আশপাশে ঘুরঘুর করে। লেখকঃ আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।
চাতক পাখি | Pied cucko | Clamator jacobinus
চাতক পাখি | ছবি: ইন্টারনেট গানের গলা এদের বড়ই মধুর। ‘পিউ, পি-পি-পিউ’ সুরে ডাকে। জাদু করা সেই সুর বিলিয়ে এরা স্থান করে নিয়েছে মানুষের মনে, বাংলা সাহিত্যে ও গানে। এ দেশের খুব কম মানুষই আছেন, যারা এ পাখির নাম শোনেননি। তবে পাখিটি দেখেননি এ ধরনের মানুষের সংখ্যা তার চেয়েও অধিক। আমি নিজেও দেখিনি এতকাল। দেখেছি কেবল সেদিন। পাখি দেখতে বেরিয়েছি নিজ গ্রামে। সঙ্গে নিয়েছি একটি হাই রেজুলেশনের বাইনোকুলার। সেদিন গাঁয়ের মেঠোপথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে একটা জঙ্গলে প্রবেশ করেছি। ভরদুপুর। গা ছমছম করছে। এ জঙ্গলে ক’বছর আগে এক স্কুলমাস্টার গলায় ফাঁস লাগিয়েছেন। আমি নিজেও তার লাশ দেখেছি। স্মৃতি রোমন্থন করে একটু ভড়কে গেছি। দ্রুত প্রস্থানের উদ্যোগ নিয়েছি। বেরুতে গিয়ে নজর ঠেকেছে একটা শিরিষ গাছের উঁচু ডালে। ওখানে একটি পাখি বসে এদিক-সেদিক ঘাড় ঘুরাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে বাইনোকুলারের আইপিসে চোখ লাগিয়ে পর্যবেক্ষণে লেগে গেলাম। বেশ সুন্দর পাখি। সাদা-কালো চেহারা। অন্য সব বর্ণের উপস্থিতি নেই। আগে কখনও অমন পাখি দেখেছি বলে মনে হয়নি। ডর-ভয় ভুলে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পাখিটাকে ভালোমতো দেখে নিলাম। যখন নিশ্চিত হলাম, এটি গায়ক পাখি চাতক, তখন একটা তৃপ্তি বোধ করলাম। যাক, পর্যাপ্ত না হলেও কিছু চাতক রয়েছে রায়পুরের (লক্ষ্মীপুর) চরপাতা গ্রামে। সেদিন চাতক দেখে আমি কিছুটা অনুপ্রাণিত বোধ করেছি পাখিদের কল্যাণে কিছু একটা করতে। পরিকল্পনা করেছি, পৈতৃক সম্পত্তিতে প্রকৃতির এ সন্তানদের জন্য ছোট্ট পরিসরে একটি অভয়াশ্রম গড়তে। যাতে ওরা নির্বিঘ্নে রাতে ঘুমাতে পারে। চাতক পাখি নিয়ে চমৎকার একটি মিথও আছে। সেটি হচ্ছে,’মুমূর্ষু মা কিশোর ছেলের কাছে জলপান করতে চাইলেন। ছেলে মায়ের আকুতি ভুলে খেলায় মেতে রইল। ইতিমধ্যে মা পরপারে চলে গেছেন। ছেলে পড়েছে অনুশোচনায়। জল জল করে চেঁচিয়ে পাড়াময় ঘুরতে লাগল। এমনকি মাকে জল পৌঁছে দিতে ওপারে যেতে চাইল। অনেক দূরের পথ পাড়ি দিতে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করল পাখি বানিয়ে দিতে। সৃষ্টিকর্তা ওর আবেদনটা মঞ্জুর করলেন। হয়ে গেল সে পাখি। লোকের বিশ্বাস, ওই কিশোর আজও উড়ে উড়ে স্রষ্টার কাছে জল প্রার্থনা করছে। এদের বাংলা নাম: ‘চাতক পাখি,| ইংরেজি নাম: ‘পায়েড কুক্কু’ (Pied cucko)| বৈজ্ঞানিক নাম: ‘ক্লামেটর জাকোবিনাস’ (Clamator jacobinus)। গোত্রের নাম: ‘কুকুলিদি’। এ পাখি লম্বায় ৩৩-৩৫ সেন্টিমিটার। বর্ণ সাদা-কালো। ঝুঁটি, ঘাড়, পিঠ ও ডানা কালো। ডানার পাশটায় সামান্য সাদা ছোপ। গলা, বুক, পেট, লেজের নিচটা কালো। লেজের প্রান্ত সাদাটে। চক্ষু, পা কালো। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম। চেহারায় রাগী ভাব। তবে অত হিংস্র নয়। গ্রামাঞ্চলের মানুষ এদেরকে বড় বুলবুল পাখি বলে ভুল করে। এরা গাছের উঁচু ডালে অবস্থান করে। মাঝেমধ্যে মাটিতে নেমে আসে। মাটিতে হাঁটে লাফিয়ে লাফিয়ে। সমানতালে পা চালিয়ে হাঁটতে পারে না। প্রধান খাবার: ঘাসফড়িং, শুয়োপোকা, পিঁপড়া, লতাগুল্মের কচিপাতা। প্রজনন সময় জুন থেকে আগস্ট। কোকিলের মতো পরের বাসায় ডিম পাড়ে। নিজেরা বাসা বাঁধতে জানে না। ডিমের সংখ্যা ১-২টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৮-২০ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক সমকাল, 31/08/2012
বড় বসন্ত বাউরি | Large green barbet | Megalaima zeylanica
বড় বসন্ত বাউরি | ছবি: উইকিপিডিয়া মুন্সীগঞ্জের ‘নগরকসবা বড়বাড়ি’। বেড়াতে যেতে হবে। ফোন করেছে আমার এক বোন। ওর অভিযোগ বিস্তর। বেড়াতে যাইনি কেন, এটি ছিল গুরুতর অভিযোগের একটি। কথা দিয়েছি বেড়াতে যাব। বলল, ‘আসার সময় পাখি দেখার জিনিসপত্র নিয়ে আসবেন।’ কথাটা শুনে বুঝে গেছি সব। উৎসাহ বেড়েছে অনেকটাই। পাখির নাম জিজ্ঞেস করতে সোজাসাপ্টা জবাব, ‘চিনি না।’ শুনে রাতের ঘুম হারাম। যেহেতু পাখিটি সে চেনে না, তাহলে নিশ্চয় দুর্লভ কোনো পাখি হবে!১৪১৯-এর পহেলা বৈশাখ। অফিস বন্ধ। কাজেই মোক্ষম সুযোগ এটি। দেরি না করে সরঞ্জামাদি ব্যাগে গুছিয়ে রেখে ছেলেকে নিয়ে বোনের বাসায় হাজির। আমাদের আগমনে সে ভীষণ খুশি। বাড়ির চারপাশটা ঘুরিয়ে দেখিয়েছে প্রথম। সে সুবাদে বাগানে একটা ‘ধূসর কসাই’ পাখির সাক্ষাৎ পেয়েছি। ক্যামেরাবন্দি করতে ভুলিনি ওটাকে। ছবিটা কখন প্রয়োজন পড়ে বলা যায় না। কথা প্রসঙ্গে জানতে চেয়েছি, ‘কোন পাখিটার কথা বলেছ আমাকে? কথার জবাব না দিয়ে বোন ওর শোবার ঘরে নিয়ে গেল আমাদের। মুখ খুলল এবার। বলল, ‘বিছানায় বসে পূর্বদিকের মরা গাছটার দিকে তাকান।’ শোবার ঘরের জানালা থেকে আনুমানিক ফুট দশেক দূরে অর্ধমৃত গাছটার অবস্থান। পত্রপল্লবহীন বেচারি দাঁড়িয়ে আছে এক ঠায়। গাছটির সমস্ত শরীর উলঙ্গ। ছাল-বাকল অবশিষ্ট নেই একটুও। ওর অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়েছে পাখি দুটি। গাছের একেবারে গলার পাশে ছোট্ট পরিধির একটি কোটর বানিয়েছে। ধরে নিয়েছি ওটি কাঠ ঠোকরার বাসা। মনটা খারাপ করে ক্যামেরা তাক করেছি মাত্র, অমনি সাপের মাথার মতো একটি মাথা বেরিয়ে এলো। বড় দুটি চোখ প্রসারিত করে একটি পাখি সবে উঁকি দিয়েছে কোটর থেকে। ছেলে চেঁচিয়ে উঠেছে, ‘ ওই যে।’ ওকে ইশারায় চুপ থাকতে বলেছি। এ ফাঁকে পাখিটি কোটর থেকে বেরিয়ে পাশের গাছের ডালে অবস্থান নিয়েছে। সুযোগ পেয়ে বেশকিছু ছবি তুলে ফেলেছি। ‘ব্যস সেরেছে। বেড়াতে আসাটা সার্থক হয়েছে আমার।’ উচ্চস্বরে বোনকে জানিয়েছি। যে পাখিটার কথা বলেছি সেটি হচ্ছে, ‘বড় বসন্ত বাউরি।’ খুব কম দেখা যায় এ দেশে। দুর্লভ বলা যায়। সমগ্র পৃথিবীতে রয়েছে প্রায় ৭৬ প্রজাতির বসন্ত বাউরি। তন্মধ্যে এটিই বড় প্রজাতি। কোকিলের মতো এদের বসন্তকালে বেশি দেখা যায়। বাংলা নাম: বড় বসন্ত বাউরির ইংরেজি নাম: ‘লার্জ গ্রিন বারবেট (Large green barbet)।’ বৈজ্ঞানিক নাম: ‘মাগালাইমা জেলানিকা (Megalaima zeylanica)|’ গোত্র ‘মেগালাইমিদি’ (Megalaima)| লম্বায় ৩০-৩৫ সেন্টিমিটার। পাখিটা দেখতে সম্পূর্ণ সবুজ মনে হলেও, আসলে আরও কিছু বর্ণ লুকিয়ে রয়েছে ওদের পালকে। মাথা ও গলা হালকা বাদামি। গলার নিচে সাদা টান। চোখের মণি বড়, চারপাশটা হলুদাভ-কমলা। ঠোঁট ও পা হালকা হলুদ। কপাল এবং পালকের উপরিভাগ গাঢ় বাদামি। নাকের গোড়ায় গোঁফের মতো কিছু খাড়া লোম রয়েছে। লেজটা খাটো। শরীরের তুলনায় মাথাটা বড়। ফলে চেহারার মায়াবীভাব হ্রাস পেয়েছে। বড় বসন্ত বাউরির প্রধান খাদ্য ফলমূল। এদের কণ্ঠস্বরে রয়েছে এক ধরনের বিষণ্নতা। কুক … কুক শব্দে ডাকে। ডাকটা শুনতে ভালোই লাগে। দূর থেকেও শোনা যায়। বড় বসন্ত বাউরির প্রজনন মৌসুম মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত। গাছের কোটরে ডিম পারে। ডিমের সংখ্যা ২-৪টি। স্ত্রী-পুরুষ ডিমে পালা করে তা দেয়। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২১ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক সমকাল, 27/04/2012
নীলাঞ্জনা পাখি | Blue whistling thrush | Myophonus caeruleus
নীলাঞ্জনা পাখি | ছবি: ইন্টারনেট পাখিটির ইংরেজি নাম: ‘ব্লু হুইসলিং থ্রাস’ (Blue whistling thrush)| বৈজ্ঞানিক নাম: ‘মাইওফোনাস সারুলিয়াস’ (Myophonus caeruleus)| গোত্রের নাম: ‘মুস্কিকাপিদি’। এ পাখিটির বাংলা আদি কোনো নাম নেই। আমাদের দেশের পাখি গবেষকরা নাম দিয়েছেন ‘নীলাঞ্জনা পাখি’। নামটির ভেতর চমৎকার একটি সাহিত্যবোধ লুকিয়ে রয়েছে। পাখিটি লম্বায় ৮-১০ ইঞ্চি। আকৃতি শালিকের মতো। পিঠের পালক রূপালি নীলচের ওপর সাদা বুটির মতো কাজ করা। মাথাটা নীলচে কালো। ডানা ঝকঝকে নীল। কনীনিকা কালো, ঠোঁট হলুদ, পা ও আঙুল ছাই কালো। তুলনামূলকভাবে পা একটু লম্বা। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম।এগুলোর মূল বাসভূমি উত্তর বেলুচিস্তানের পাহাড়ি জঙ্গল থেকে শুরু করে উত্তর-পূর্ব অরুণাচল প্রদেশ পর্যন্ত। প্রচণ্ড শীতে এগুলো হিমালয়ের পাদদেশ থেকে আমাদের দেশে চলে আসে। এগুলোর প্রধান খাবার পোকামাকড়, যা এ অঞ্চলে প্রচুর পাওয়া যায়। ফলে এগুলো এ দেশেই বেশি সময় কাটিয়ে দেয়। শুধু প্রজননের সময় হিমালয় অঞ্চলে চলে যায়। প্রজননকাল এপ্রিল-জুন। এ সময় পুরুষ পাখিটি সকাল-সন্ধ্যা হুইসেলের মতো শব্দ করে স্ত্রী পাখির দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে। জুটি বাঁধার পর পাহাড়ি জলাধারের কাছাকাছি গাছের ডালে পেয়ালা আকৃতির বাসা বানায়। ডিম পাড়ে ২-৩টি। বাচ্চা ফুটতে সময় নেয় ১৮-২০ দিন। বাচ্চা স্বাবলম্বী হলে পুরুষ পাখিটি আলাদা হয়ে যায়। পরবর্তী প্রজনন মৌসুম পর্যন্ত একা একা বিচরণ করে। পরের বছর অন্য স্ত্রী নীলাঞ্জনার সঙ্গে সংসার পাতে। গান গেয়ে মজাতে পারলে সাবেক স্ত্রীর সঙ্গে ঘর বাঁধার অনুমতি মেলে। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক সমকাল, 25/05/2012
আবাবিল | Barn swallow | Hirundo rustica
আবাবিল | ছবি: ইন্টারনেট পবিত্র কোরআন শরিফের ‘সুরা ফিল’-এর ৩ নং আয়াতে একটি পাখির বর্ণনা আছে। পাখিটির নাম ‘আবা-বিল’। সেটিই আমাদের দেশের আবাবিল পাখি। সে কারণে পাখিটির প্রতি দুর্বলতাও সৃষ্টি হয়েছে। যেভাবে হোক এ পাখি চিনতে হবে। এর আগে কালো লেজচেরা যে পাখিকে আবাবিল পাখি হিসেবে জেনেছি, সেটি আসলে আবাবিল নয়। দেখতে অবিকল আবাবিলের মতো হলেও ওরা অন্য গোত্রের। যারা আবাবিল পাখি চেনেন না, তাদের ধারণা, ওরাই আবাবিল। বেশিরভাগ মানুষের ধারণা, সাধারণত আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে আবাবিল উত্তর-পূর্ব এশিয়া থেকে হিমালয় পেরিয়ে এ দেশে আসে। ফিরে যায় এপ্রিল থেকে মে নাগাদ। অর্থাৎ ৮-৯ মাস এ দেশে অবস্থান করে। আগেই বলেছি, এ পাখির প্রতি দুর্বলতা পবিত্র কোরআনের উদৃব্দতি থেকে। কাজেই আবাবিল চেনা চাই-ই। খুব বেশি দূরে যেতে হয়নি এ পাখি দেখতে। বছর তিনেক আগে চর ইন্দুরিয়ায় গেছি। এটি রায়পুর (লক্ষ্মীপুর) উপজেলায় অবস্থিত। আমার সঙ্গে ছিল অনুজ সাংবাদিক এবিএম রিপন। রায়পুর থেকে খানিকটা দূরে চর ইন্দুরিয়া। আগে কখনও যাওয়া হয়নি। এই প্রথম মেঘনার চরে গেছি। বিশাল চর। চারদিকে ধুধু বালুচর। রোদে পুড়ে খাঁ খাঁ করছে চরের বালুকারাশি। বালুকারাশির ওপর তীক্ষষ্ট সূর্যরশ্মি ছড়িয়ে পড়াতে দৃষ্টি দেওয়া কঠিন হয়ে গেছে। চোখ ধাঁধিয়ে উঠছে নিমেষেই। অনেক কষ্টে দৃষ্টি প্রসারিত করে খোলা প্রান্তরের আশপাশ দেখে নিচ্ছি। প্রকৃতিকে উপভোগ করার মুহূর্তেই আমার নজরে পড়েছে এক ঝাঁক লেজচেরা পাখি। ওরা চরের ওপর চক্কর দিচ্ছে। বসছে না কোথাও। দলছুট দু’একটি পাখি উড়ন্ত অবস্থায় পতঙ্গের পিছু নিচ্ছে। প্রায় ৯০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে ছোঁ মেরে শিকার ধরছে। দৃশ্যটি মজাদার বটে। তাকিয়ে রয়েছি অনেকক্ষণ। ওদের বসার অপেক্ষায় রয়েছি। না হলে ভালো করে দেখা যাবে না। মিনিট পঁচিশেক অপেক্ষার পর সে সুযোগটি এসেছে। মাত্র দুটি পাখি চরের পাশে পত্রপল্লবহীন একটি গাছের ডালে বসেছে। সে সুবাদে ওদের খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার সুযোগ হয়েছে আমার। এ পাখির রঙ-রূপ আহামরি না হলেও দেখতে একেবারে মন্দ লাগেনি। পরখ করে দেখলে মায়াবী মুখটা ধরা পড়ে। বলে রাখা ভালো চর ইন্দুরিয়ার পাশেই ‘চর আবাবিল’ নামে একটি প্রসিদ্ধ স্থান রয়েছে। মিথ থেকে জানা গেছে, আবাবিল পাখিদের আধিক্যের কারণেই এ নামকরণ। বাংলা নাম: ‘আবাবিল’, ইংরেজি নাম: ‘বার্ন সোয়ালো’ (Barn swallow), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘হিরানডো রাসটিকা’ (Hirundo rustica), গোত্রের নাম: ‘হিরানডিনিদি’। লম্বায় ১২-১৩ সেন্টিমিটার। কপাল গাঢ় বাদামি। পিঠ পালিশ করা গাঢ় নীল। ডানার পালক, লেজ কালচে। চিবুক, গলা বাদামি। বুক মলিন সাদা। পা কালো। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। আবাবিল পাখির লেজ চেরা। উড়লে চিলতে চাঁদের মতো দেখায়। কীটপতঙ্গ আবাবিলের প্রধান খাবার। এরা উড়ন্ত অবস্থায় পতঙ্গ শিকার করে। দলবদ্ধভাবে শিকার খোঁজে। নদী, বিল, হাওর-বাঁওড় কিংবা বালুচরে এদের দেখা যায় বেশি। আবাবিল পাখি যদিও গায়ক পাখির আওতায় পড়ে না, তথাপি সুরটা মধুর। ‘চিক্- চিক্… লি উইট’ সুরে ডাকে। প্রজনন সময় এপ্রিল থেকে জুলাই। বাসা বানায় পুরনো দালানের ফাঁকফোকরে। ডিম পাড়ে দু-তিনটি। মৌসুমে দু’বার ডিম দিতে দেখা যায়। স্ত্রী-পুরুষ উভয়েই ডিমে তা দেয়। ফুটতে সময় নেয় ১৬-১৮ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক সমকাল, 18/08/2012
দুধরাজ | Asian paradise flycatcher | Terpsiphone paradisi
দুধরাজ | ছবি: ইন্টারনেট শুধু গাছগাছালি নয়, প্রকৃতির সব ধরনের সুন্দরের আবাসস্থলই সুন্দরবন। যারা এ বনে গেছেন, তাদের বিষয়টি বুঝিয়ে বলার দরকার নেই। তবে এটুকু বলতে হয়, একবার এ বনে গেলে বারবার যেতে ইচ্ছা করে যে কারোরই। এমনই অহঙ্কারী রূপ সুন্দরবনের। গিয়েছি সুপতির (শরণখোলা রেঞ্জ) জঙ্গলে। রেঞ্জ অফিসে প্রবেশ করে আমাদের আগমনের উদ্দেশ্য জানিয়েছি ডেপুটি রেঞ্জারকে। তিনি আপ্যায়ন করে বনের ভেতরে ঢোকার সুযোগ করে দিলেন। নদীর তীর ধরে হাঁটছি। কিছু অচেনা পাখি নজরে পড়তেই ক্যামেরাবন্দি করে নিয়েছি। এরই মধ্যে দেখতে পেয়েছি উঁচু গাছের ডালে বসে রয়েছে একটি ধবধবে সাদা পাখি। দেখে হাঁ করে তাকিয়ে রয়েছি। এ কী দেখছি! পাখি তো! দুধসাদা রঙের এ পাখি আগে কখনও দেখিনি। নাম শুনেছি। এবার নিজ চোখে দেখেছি। এ পাখির রূপের বর্ণনা দেওয়ার সাধ্য নেই। সংক্ষেপে শুধু এটুকুই বলব, আমাদের দেশের পাখিবিশারদরা এদের ‘স্বর্গীয় পাখি’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। পাখিটার বাংলা নাম: ‘দুধরাজ’। অঞ্চলভেদে সুলতান বুলবুল, হোসনি বুলবুল, নন্দনপাখি ইত্যাদি নামে পরিচিত। ইংরেজি নাম: ‘এশিয়ান প্যারাডাইস ফ্লাইক্যাচার’ (Asian paradise flycatcher), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘টেপসিফোন প্যারাডিসি’ (Terpsiphone paradisi)। পাখিটি বেশ লম্বা। লেজ ছাড়া ১৯-২২ সেন্টিমিটার। লেজসহ প্রায় ৩৩ সেন্টিমিটার লম্বা। শরীরের গড়ন চিকন। মাথায় কালো রঙের ঝুঁটি। ঝুঁটির চুলগুলো পালিশ করা কালো। কপালও কালো। ঠোঁট নীলচে, সামান্য বাঁকানো। গলা, বুক কালো। চোখের মণি নীল। পায়ের রঙ হালকা লালচে। পিঠের পালক অধিকাংশই ধবধবে রূপালি সাদা। ডানা ও লেজের পালক সাদা। কয়েকটা পালকে সাদার মাঝখানে কালো লম্বা লাইন। লম্বা লেজটি দুই পালক বিশিষ্ট। চুলের ফিতার মতো। এ হচ্ছে পুরুষ দুধরাজের শারীরিক বর্ণণা। অপরদিকে সম্পূর্ণ বিপরীত চেহারা স্ত্রী দুধরাজের। ওদের লম্বা লেজ থাকে না। দেখতে সুশ্রীও নয়। মাথায় ঝুঁটি রয়েছে ঠিকই তবে পুরুষের মতো আহামরি রূপ নেই। পিঠের রঙ হালকা বাদামি, পেটে ধুসরের সঙ্গে সাদার মিশ্রণ। পাখিবিশারদ ছাড়া অন্য যে কেউ প্রথম দেখলে দুটিকে দুই প্রজাতির বলে ভুল করবেন। কণ্ঠস্বর কর্কশ। ভয় পেলে ‘কই কোঁ..কি.. ই..ই..ই..ক্যাঁচ..’ শব্দে চেঁচিয়ে ওঠে। প্রজনন মৌসুমে মোলায়েম সুরে ডাকাডাকি করে। এরা পাঁচ ধরনের সুরে ডাকতে পারে। কোনোটিই শ্রুতিমধুর নয়। স্বভাবে চঞ্চল। সুন্দরবনের বনমোরগ ওদের বন্ধু। সর্বদাই বনমোরগ-মুরগীর সঙ্গে ওঠবস করে। কারণ বনমোরগ ওদের শক্ত ঠোঁট দিয়ে মাটি খুঁচিয়ে খাবার সংগ্রহ করার সময় পোকামাকড় উঠে এলে তা খায় দুধরাজ। অপরদিকে বনমোরগেরও স্বার্থ আছে দুধরাজকে কাছে রেখে। সাপ-বেজি, বনবিড়াল ইত্যাদি নজরে এলে সঙ্গে সঙ্গে কর্কশ শব্দ করে বন্ধুকে জানিয়ে দেয়। দুধরাজ শুধু সুন্দরবনে নয়, লোকালয়েও বাস করে। তবে একেবারেই কম। দুধরাজের প্রিয় খাবার কীটপতঙ্গ। প্রজনন সময় ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই। গাছের সর্বোচ্চ ডালে ঘাস, লতাপাতা, মাকড়সার জাল দিয়ে পেয়ালা আকৃতির বাসা বানায়। ডিম পাড়ে ৩-৫টি। ডিম ফোটে ১৮-২০ দিনে। সব ডিম ফোটে না, সব শাবক বাঁচেও না। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক সমকাল, 22/09/2012
নওরঙ | Indian pitta | Pitta brachyura
নওরঙ | ছবি: ইন্টারনেট এরা ভারি লাজুক পাখি। গলাটা মিষ্টি। গান শুনলে যে কারোরই ভালো লাগবে। হয়তো এমনও হতে পারে শ্রোতা ওদের গানে মজে গিয়ে খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিয়েছেন। কিন্তু দেখা পাচ্ছেন না। হন্যে হয়ে খুঁজছেন, তারপরও বের করতে পারছে না ওর অবস্থান। কারণ এরা গাছের পাতার আড়ালে নিজেকে বন্দি করে রাখে কৌশলে। এ পাখির বাংলা নাম অনেক। বর্ণালি, শুমচা, নীলপাখি ইত্যাদি। হিন্দি নাম নওরঙ। কোনো কোনো অঞ্চলে হালতি পাখি নামে পরিচিত। পশ্চিমবঙ্গের পক্ষীবিশারদ ‘অজয় হোম’ হিন্দি নামটার বাংলা করেছেন ‘বর্ণালি’। তবে এ দেশে ‘নওরঙ’ নামে বেশি পরিচিত। নওরঙের ইংরেজি নাম: ‘ইন্ডিয়ান পিট্টা,(Indian pitta)’ বৈজ্ঞানিক নাম: ‘পিট্টা ব্রাকাইউরা'(Pitta brachyura) গোত্রের নাম: ‘পিট্টিদি’। লম্বায় নওরঙ ২০-২১ সেন্টিমিটার। লেজ একেবারেই খাটো। প্রথম দেখাতে মনে হবে বুঝি ওদের লেজই নেই। খুব ভালো করে পরখ করলে লেজটা ধরা পড়বে। ওদের পালকে রয়েছে লাল, সাদা, কালো, হলুদ, নীল, সবুজ ও বাদামি রঙের সংমিশ্রণ। মাথার ওপরটা হলদেটে পট্টির মতো। গলার নিচটা সাদা। চোখের দু’পাশ মোটা দাগের কাজল কালির টান দেওয়া। দাগটি একেবারে ঘাড়ে এসে ঠেকেছে। চোখের ওপর রয়েছে সরু সাদা টানা দাগ। পিঠ, কাঁধ সবুজ। ঠোঁট কালো। ডানার শুরুটা নীল, নিচের অংশ বাদামি। বুকের তলার দিকে লালচে বাদামি। লেজের নিচের পালক টুকটুকে লাল। পা ফিকে বেগুনি। নওরঙ পাতাঝরা জঙ্গলের বাসিন্দা। মাটিতে বিচরণ করে সর্বদাই। মাটিতে পড়ে থাকা পাতা উল্টে-পাল্টে খাবারের সন্ধান করে। কেঁচো, পোকামাকড় প্রধান খাবার।মিষ্টি গলার নওরঙ শিস দেয় বেশ উচ্চস্বরে। ‘হুই হুইট-টিউ… টিউট টিউট টু…’ সুরে গান গায়। সুরে ছান্দসিক তাল আছে। পুরুষের তুলনায় স্ত্রী পাখি গানে বেশি পারদর্শী। গান গাওয়ার সময় মাথাটা ঘাড়ে ঠেকিয়ে আকাশমুখী হয়ে গান গায়। খুব বেশি উড়াল দিতে পারে না নওরঙ। থেমে থেমে ওড়ে। প্রজনন মৌসুম আষাঢ় থেকে শ্রাবণ। নিচু গাছের ডালে বাসা বাঁধে। বাসা লম্বাটে ধাঁচের। ডিম পাড়ে ৪ থেকে ৬টি। ডিম ফুটতে সময় নেয় ১৪ থেকে ১৬ দিন। বাচ্চা উড়তে শেখে ২০ থেকে ২৫ দিনে। উড়তে শেখার আগেই বাচ্চারা মাটিতে নেমে মায়ের পেছন পেছন হাঁটাহাঁটি করে। সে মুহূর্তেই বাচ্চারা বিপদে পড়ে যায় বেশি। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক সমকাল, 01/06/2012