দেশি মেটেধনেশ | Indian Grey Hornbill | Ocyceros birostris
দেশি মেটেধনেশ | ছবি: ইন্টারনেট দেশের প্রাক্তন আবাসিক পাখি অদ্ভুত গড়নের ‘দেশি মেটেধনেশ’। এক সময় রাজশাহী বিভাগের গ্রামীণ বনাঞ্চলে দেখা যেত। শুষ্ক বনভূমির উঁচু গাছ-গাছালিতে বিচরণ করত। হালে দেখা যাওয়ার নজির নেই। বাংলাদেশ ছাড়াও এদের বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত, নেপাল ও পাকিস্তানে। বিশ্বে বিপন্মুক্ত হলেও দেশি মেটেধনেশ বাংলাদেশে বিপন্ন হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। তথাপিও প্রজাতিটিকে বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে সংরক্ষিত ঘোষণা করা হয়নি। আমাদের দেশে মোট চার প্রজাতির ধনেশের সাক্ষাৎ মেলে। এদের প্রতিটি প্রজাতিরই স্বভাব কিংবা খাবার একই ধরনের। ধনেশ প্রজাতির সবাই প্রজনন সময়ে অদ্ভুত কাণ্ড ঘটিয়ে বসে। যেমন স্ত্রী পাখি স্বেচ্ছায় গাছের কোটরে ঢুকলে পুরুষ পাখি ওকে বন্দি করে রাখে। কোটরের মুখ বন্ধ করে দেয় কাদামাটি দিয়ে। পুরুষ পাখি নিজেই কাদামাটি বহন করে এনে ঠোঁট দিয়ে লেপে দেয়। শুধু ছোট্ট একটি ছিদ্র রাখে বায়ু চলাচল এবং খাবারের জোগান দিতে। পুরুষ পাখিকেই খাবারের জোগান দিতে হয় তখন। ডিম-বাচ্চা ফুটলেও খাদ্যের চাহিদা মেটায় পুরুষ পাখিই। শাবক স্বাবলম্বী হওয়ার আগ পর্যন্ত পুরুষ পাখিকেই খাবার জোগানে ব্যস্ত থাকতে হয়। বাচ্চারা ফুরফুরে হলে ভেতর থেকে মা পাখি ঠোঁট দিয়ে ঠুকরিয়ে মাটির আস্তর ফুটো করে বেরিয়ে আসে। পাখির বাংলা নাম: ‘দেশি মেটেধনেশ’, ইংরেজি নাম: ‘ইন্ডিয়ান গ্রে হর্নবিল’ (Indian Grey Hornbill), বৈজ্ঞানিক নাম: Ocyceros birostris | এরা ‘পুটিয়াল ধনেশ’ নামেও পরিচিত। লম্বায় ৬১ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখির মধ্যে তেমন কোনো তফাত নেই। যেটুকু তফাত নজরে পড়ে সেটি হচ্ছে, স্ত্রী পাখির ঠোঁটের ওপরের বর্ম ছোট ও ঠোঁটের ডগা অস্পষ্ট। বাদ বাকি পুরুষ পাখির মতোই। প্রজাতির পিঠ বাদামি-ধূসর। শরীরের পালকগুলো দেখতে অনেকটাই বালুকাময় মনে হয়। দেহের নিম্নাংশ কালচে ধূসর। ধূসর লম্বা লেজের মধ্য পালকের প্রান্ত সাদা। চোখের ওপরের ভ্রু প্রশস্ত সাদা। কান ঢাকনি কালচে ধূসর। ঠোঁট বাঁকানো, সূচালো। ঠোঁটের ওপর শক্তপোক্ত সেøট-কালো রঙের শিরন্ত্রাণ। পা ও পায়ের পাতা সেøট-কালো। অপ্রাপ্তবয়স্কদের ঠোঁট হলুদ, শিরন্ত্রাণ নেই। প্রধান খাবার: গিরগিটি, টিকটিকি, ইঁদুর, গুবরে পোকা, ফল ও ফুলের পাপড়ি। প্রজনন মৌসুম মার্চ থেকে জুন। গাছের প্রকৃতিক কোটরে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ২-৪টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ৩৫-৩৭ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 26/09/2014
পাটকিলে মাথা ছাতারে | Chestnut capped Babbler | Timalia pileata
পাটকিলে মাথা ছাতারে | ছবি: ইন্টারনেট আবাসিক পাখি। দেখতে চমৎকার। গ্রামীণ বনেবাদাড়ে অল্পবিস্তর নজরে পড়ে। সমগ্রবিশ্বে এদের অবস্থান খুব বেশি সন্তোষজনক নয়। বাংলাদেশ ছাড়াও বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত, নেপাল, মিয়ানমার, চীন, লাওস, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনাম পর্যন্ত। এরা বেশ সামাজিক পাখি। প্রজননকালীন জোড়ায় জোড়ায় বিচরণ করলেও ছোট দল দেখা যায়। রাত্র যাপনও করে দলবদ্ধভাবে। দলের একটি পাখি যে দিকে উড়ে যায় অন্যরাও সেদিকে উড়তে থাকে। আবার কেউ যদি পথ হারিয়ে ফেলে অন্যরা ডাকাডাকি করে তাকে পথ চিনিয়ে নিয়ে আসে। সবচেয়ে মজাদার বিষয়টি হচ্ছে এদের দলের কেউ ডিম-বাচ্চা ফুটালে শাবকদের যত্ন আত্তি দলের সবাই মিলেই করে। অনেক সময় দলের সবাই মিলে অন্যের ডিমে তা দিতে দেখা যায়। এরা মূলত জলাশয় এলাকায় বিচরণ করে। বিশেষ করে শনবন, নলখাগড়ার বনের ভেতর আড্ডা জমে ভালো। এদের গানের গলা বেশ সুমধুর। ভারি মিষ্টি সুরে গান গায়। প্রজাতিটি বিশ্বব্যাপী ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। আইইউসিএন প্রজাতিটিকে লাল তালিকাভুক্ত করেছে। পাখির বাংলা নাম: ‘পাটকিলে মাথা ছাতারে’, ইংরেজি নাম: ‘চেস্টনাট ক্যাপেড ব্যাবলার’ (Chestnut-capped Babbler), বৈজ্ঞানিক নাম: Timalia pileata | এরা ‘লালটুপি ছাতারে’ নামেও পরিচিত। এরা দৈর্ঘ্য ১৫-১৭ সেন্টিমিটার। ওজন ১৫-২৩ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। কপালে সাদা টান। মাথায় পাটকিলে অথবা মদ-বাদামি রঙের টুপি। থুঁতনি কালো। ঘাড়ে মালাসদৃশ ছাই ধূসর রেখা। পিঠ বাদামি। বাদামি লেজে কালচে ডোরা দাগ। দেহের তুলনায় লেজ খানিকটা লম্বা। গলা সাদা। পেট থেকে বস্তিপ্রদেশ পর্যন্ত হালকা বাদামি। লেজতল কালচে। চোখের মণি বাদামি। ঠোঁট নীলচে কালো। পা কালচে। প্রধান খাবার: শুঁয়োপোকা, গোবরেপোকা ও অন্যান্য কীট-পতঙ্গ। ছোট ফল-ফলাদি, খেজুরের রসের প্রতিও আসক্তি রয়েছে। প্রজনন মৌসুম এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুম হেরফের রয়েছে। জলাশয়ের কাছাকাছি ঘাসবন কিংবা লতাগুল্মের ভেতর ডিম্বাকৃতির বাসা বানায়। ডিম পাড়ে ৩-৪টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৪-১৬ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 04/03/2016
বাদামিবুক চটক | Brown breasted Flycatcher | Muscicapa muttui
বাদামিবুক চটক | ছবি: ইন্টারনেট চড়–ই আকৃতির পরিযায়ী পাখি। দেখতে আহামরি না হলেও চেহারাটা মায়াবী ধাঁচের। স্বভাবে শান্ত। কিছুটা ভিরু প্রকৃতির। উড়ন্ত পোকামাকড় এদের প্রধান শিকার। উড়ন্ত পোকামাকড় নজরে পড়লে ব্যতিব্যস্ত হয়ে শিকারের পিছু নেয়। বেশির ভাগই একাকী বিচরণ করে। বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ ব্যতিত উত্তর-পূর্ব ভারত, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, দক্ষিণ চীন ও থাইল্যান্ড পর্যন্ত। প্রাকৃতিক আবাসস্থল সুঁচালো চিরহরিৎ বন। ভূপৃষ্ট থেকে ১৫০০ মিটারের উঁচুতেও এদের বিচরণ রয়েছে। তবে যেখানেই বিচরণ করুক না কেন জায়গাটা ঝোপঝাড় মুক্ত হওয়া চাই। বিশ্বে এদের অবস্থান তত সন্তোষজনক নয়, আবার অঞ্চলভেদে কিছুটা দুর্লভও। পাখির বাংলা নাম: ‘বাদামিবুক চটক’, ইংরেজি নাম: ‘ব্রাউন ব্রেস্টেড ফ্লাইক্যাচার’ (Brown-breasted Flycatcher), বৈজ্ঞানিক নাম: Muscicapa muttui| এরা ‘মেটেবুক চুটকি’ নামেও পরিচিত। প্রজাতির দৈর্ঘ্য ১৩-১৪ সেন্টিমিটার। ওজন ১০-১৪ গ্রাম। মাথা, ঘাড়, পিঠ ও লেজের গোড়া পর্যন্ত জলপাই বাদামি (অনেক সময় মেটে বাদামি মনে হতে পারে)। ডানা এবং লেজের পালক উজ্জ্বল বাদামি। চিবুক ফ্যাকাসে বাদামি। গলা সাদা। বুক মেটে বাদামি। চোখের বলয় কালো, বলয়ের পাশে সাদাছোপ। ঠোঁট ত্বক বর্ণের সঙ্গে কালচে আভা। পা হলদে কমলা অথবা ফ্যাকাসে। প্রধান খাবার: পতঙ্গ, মাছি বা ছোট অমেরুদণ্ডী প্রাণী। প্রজনন মৌসুম এপ্রিল থেকে জুন। গুল্মঝোপের ভেতর কাপ আকৃতির বাসা বাঁধে। বাসা বানাতে উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে শৈবাল, তন্তু ইত্যাদি। ডিম পাড়ে ৪-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৩-১৫ দিন। শাবক উড়তে শিখে সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই। লেখক: আলমশাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণীবিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 24/02/2017
কালি ময়ূর | Kalij pheasant | Lophura leucomelanos
কালি ময়ূর | ছবি: ইন্টারনেট প্রায় সাড়ে তিন যুগ আগেও আমাদের দেশের গহিন জঙ্গলগুলোতে এ পাখির প্রচুর বিস্তৃতি ছিল। বিশেষ করে চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, শ্রীমঙ্গলের চা বাগানে স্থায়ী বাসিন্দা ছিল এরা। আমাদের দেশের পাখি বিশারদরা জানিয়েছেন, কয়েক যুগ আগেও মধুপুরের শালবনে পাওয়া যেত এই পাখি। এখন আর নজরেই পড়ে না। শিকারিদের দৌরাত্বে পাখিটি শালবন থেকে হারিয়ে গেছে। এখন শুধুমাত্র পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং শ্রীমঙ্গলের চা বাগানে কালেভদ্রে নজরে পড়ে। আমি বছর দশেক আগে প্রথম এ পাখিটি দেখি পার্বত্য চট্টগ্রামের চিরসবুজ অরণ্যে। তবে সংখ্যায় খুব বেশি ছিল না। মাত্র দুটি পাখি দেখেছি সেদিন। মোরগাকৃতির এ পাখি দুটিকে দেখে সেদিন ভীষণ মুগ্ধ হয়েছি। স্থানীয় লোকজনের কাছে পাখিটার নাম জানতে চেয়েছি। তারা জানিয়েছেন এগুলোর নাম ‘কালা মুরকা।’ এ-ও জানিয়েছেন তারা জঙ্গলের আশপাশে এ পাখি শিকার করতে ওঁৎ পেতে থাকেন। এগুলো খুব ভোরে ও সূর্যাস্তের সামান্য আগে জঙ্গল থেকে ফাঁকা স্থানে বেরিয়ে আসে। সে সুযোগে শিকারিরা এগুলোকে শিকার করে। এই পাখির মাংস পাহাড়িদের কাছে বেশ প্রিয়। বাংলায় এই পাখির কোনো নাম নেই। আমাদের দেশের পাখি গবেষকরা এর নাম দিয়েছেন ‘কালি ময়ূর।’ নামটি বেশ মানানসই বলা যায়। ইংরেজি নাম: ‘কালিজ ফেজেন্ট’, (Kalij pheasant) বৈজ্ঞানিক নাম: ‘লোফুরা লিউকোমেলানোস’, (Lophura leucomelanos) গোত্র: ‘ফাজিয়ানিদি’। কালি ময়ূর স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম মনে হলেও সামান্য পার্থক্য রয়েছে যা পাখি বিশারদের নজর এড়াতে পারবে না। তবে সাধারণের চোখে পার্থক্যটা সহজে ধরা পড়বে না। পার্থক্যটা হচ্ছে, পুরুষ পাখি লম্বায় ৬৫-৭৫ সেন্টিমিটার, স্ত্রী পাখি ৫০-৬০ সেন্টিমিটার। পুরুষ পাখির শরীরের ওপরের দিকটার পালক চকচকে কালোর সঙ্গে ধাতব মিশ্রণ। নিুাংশ সাদাটে। চোখের চারপাশটা ও লতিকা টকটকে লাল। স্ত্রী কালি ময়ূর দেখতে হালকা বাদামি তবে কোনো কোনো অংশে গাঢ় বাদামি। ঝুঁটি বাদামি রংয়ের এবং লেজটা কাস্তের মতো বাঁকানো। দেখতে বেশ চমৎকার। কালি ময়ূরদের কণ্ঠস্বর বিশ্রী। উচ্চৈঃস্বরে ডাকলে ‘চিরপ..চিরপ’ শব্দ শোনা যায়। আর স্বাভাবিক স্বরে ডাকলে ‘কুরচি…কুরচি’ শব্দ করে। দেখতে হিংস্র মনে হলেও আসলে এরা খুবই ভীরু প্রকৃতির পাখি। কালি ময়ূরের খাদ্য তালিকায় রয়েছে শস্যদানা, শস্যের কচি ডগা, কীটপতঙ্গ, ছোট সরীসৃপ ইত্যাদি। এরা বন মোরগের মতো মাটি আঁচড়ে পোকামাকড় খোঁজে। এদের প্রজননের সময় মার্চ থেকে অক্টোবর। মাটির ওপরে ঘাস কিংবা শুকনো লতাপাতা বিছিয়ে বাসা বানায়। ডিম পাড়ে ৪-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২০-২২ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 19/09/2012
তিলা ঘুঘু | spotted dove | Streptopelia chinensis
তিলা ঘুঘু | ছবি: ইন্টারনেট এ পাখির নাম শুনলেই শৈশব কৈশরের কথা মনে পড়ে যায় যে কারোই। বিশেষ করে যারা গ্রাম থেকে শহরে এসে বাস গেঁড়েছেন বোধকরি তাদের প্রত্যেকের ভেতরেই এ পাখির চিত্রটা ফুটে ওঠে। পাখিটার করুণ সুরের আর্তনাদ ‘ঘুঘু-ঘুঘু বা ক্রুরর-ক্রুরর-ক্রুরর’ আওয়াজ যখন কানে ভেসে আসে তখন শ্রোতা কান খাড়া করে ডাকটা শোনেন মনোযোগ সহকারে। শুনতে শুনতে এক পর্যায়ে হারিয়ে যান গ্রামের বাঁশঝাড় অথবা ঠা-ঠা রৌদ্দুরের কোনো এক নির্জন দুপুরে। কিংবা ছাড়া বাড়ির শুকনো খটখটে ভিটির কথা মনে পড়ে। যেখানে কোনো জনমানুষের সাড়া নেই কিন্তু বাজছে ‘ঘুঘু-ঘুঘু’ সুরের মূর্ছনা। হ্যাঁ পাঠক, তিলা ঘুঘুর কথাই বলছি। এ পাখি এখনো আমাদের গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য বহন করে। সাহিত্য কিংবা গানে এরা সমান দখলদারিত্ব বজায় রেখেছে যুগ যুগ ধরে। কিছু নিষ্ঠুর মানুষের কারণে আজ এরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। পাখিদের মধ্যে বকের পরেই এরা সবচেয়ে বেশি শিকারিদের ফাঁদে পড়ছে। কারণ এরা সুচতুর নয়। অত্যন্ত নীরিহ গোত্রের পাখি। ফলে শিকারিরা বিভিন্ন ধরনের কায়দা করে ওদেরকে ফাঁদে ফেলছে। এ ছাড়াও এয়ারগানের টার্গেটে এ পাখিই বেশি পড়ছে। আবার গ্রামগঞ্জের বিলাসি মানুষের খাঁচায় এ পাখিই বন্দি হচ্ছে বেশি। তার প্রধান কারণ ঘুঘুরা বাসা বাঁধে একেবারেই মানুষের নাগালের ভেতরে। মাঝে মধ্যে এত নিচু স্থানে বাসা বাঁধে যে, শিশু-কিশোরদের ফাঁদে শাবকসহ বড় পাখিও ধরা পড়ে যায়। তারপর সেখান থেকে শাবক চলে যায় বন্দি জীবনে। আর প্রাপ্তবয়স্ক পাখিরা চলে যায় দা-বঁটির নিচে। আমাদের সৌভাগ্য এতসব অত্যাচারের পরেও এরা সন্তোষজনক হারে এ দেশে বিচরণ করছে। আমাদের দেশে বহু প্রজাতির ঘুঘু নজরে পড়ে। উল্লেখযোগ্য হচ্ছে তিলা ঘুঘু, লাল ঘুঘু, সবুজ ঘুঘু, রাম ঘুঘু, রাজ ঘুঘু, ধূমকল, ক্ষুদে ঘুঘু ইত্যাদি। এর মধ্যে তিলা ঘুঘুর দেখা মেলে যত্রতত্র। অনেকটাই আমাদের কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করে। পাখিটার বাংলা নাম: ‘তিলা ঘুঘু’, ইংরেজি নাম: ‘স্পটেড ডাভ’, (spotted dove), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘স্ট্রেপটোপেলিয়া চাইনেনসিসি’, (Streptopelia chinensis), গোত্রের নাম: ‘কলম্বিদি’। লম্বায় এরা ২৮-৩০ সেন্টিমিটার। কপাল, মাথা, মুখ, গলা, বুক বেগুনি-গোলাপি। ডানার ওপর সাদা ছিট ছিট। ঘাড়ের দু’পাশে কালোর ওপর সাদা চিতি। লেজ কালচে-বাদামি। লেজের তলা সাদা। ঠোঁট কালচে। চোখের চারপাশের বলয় লালচে। পা-পায়ের পাতা সিঁদুরে লাল। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। তবে আকারে স্ত্রী পাখি সামান্য ছোট। এদের প্রিয় খাবার শস্যদানা হলেও ধান, কাউন, সরিষার প্রতি আসক্তি বেশি। আবার খুটে খুটে মাটিও খেতে দেখা যায়। প্রজনন সময় সেপ্টেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত। এ ছাড়াও গ্রীষ্মেও ডিম পাড়তে দেখা যায়। যে কোনো গাছেই এরা বাসা বাঁধে। নারিকেল, সুপারি, আমগাছ থেকে শুরু করে একেবারে শিম, লাউগাছের ঝোপেও বাসা বাঁধে। বাসা তৈরির উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে চিকন লতা বা শুকনো দূর্বাঘাস। ডিম পাড়ে ১-২টি। বেশিরভাগ সময় ২টি ডিম পাড়ে। স্ত্রী-পুরুষ পাখি উভয়ে মিলেই ডিমে তা দেয়। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৩-১৫ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: মানবকণ্ঠ, 18/01/2013
পাতি চখাচখি | Common Shelduck | Tadorna tadorna
পাতি চখাচখি | ছবি: ইন্টারনেট উত্তর আফ্রিকা ও ইউরোপের বহু দেশেই বৈশ্বিক বিস্তৃতি রয়েছে। এছাড়াও ভারত, নেপাল, পাকিস্তান, ভুটান, চীন, তিব্বত, জাপান, মালয়েশিয়া, ইরান ও ইরাকে দেখা যায়। বাংলাদেশের স্থায়ী বাসিন্দা না হলেও সুলভ দর্শন। দর্শনীয় চেহারাও বটে। শীতে পরিযায়ী হয়ে আসে। দেশের প্রায় বিভাগেরই নদ-নদীতে কম-বেশি বিচরণ করে। বিশেষ করে উপকূলীয় এলাকার সদ্য জেগে ওঠা চরাঞ্চলে কিংবা মোহনাতে বেশি পরিলক্ষিত হয়। খাদ্যের সন্ধানে বড় বড় দলে বিচরণ করে অগভীর জলাশয়ে। শিকার কৌশল দেশীয় গোত্রের পাতি হাঁসের মতো। সাধারণত এরা নিরীহ গোত্রের পাখি। নিজেদের মধ্যেও কোনো ধরনের কলহ-বিবাদ ঘটায় না। বলা যায় সারাদিন চুপচাপ কাটিয়ে দেয়। পুরুষ পাখি পারতপক্ষে তেমন ডাকাডাকিও করে না। স্ত্রী পাখির মনোযোগ আকর্ষণের ক্ষেত্রে কালেভদ্রে নিচু গলায় শিস কাটে। সঙ্গী জবাব দেয় তখন ‘গ্যাগ-গ্যা-গ্যা’ সুরে। প্রজাতিটি বিশ্বে বিপন্মুক্ত, বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে সংরক্ষিত। শিকারি দ্বারা নির্যাতিত হওয়া সত্ত্বেও প্রজাতিটি দেশে ভালো অবস্থানে রয়েছে। আমরা আরেকটু সদয় হলে বোধ করি এদের আগমন আরো বেশি বেশি ঘটবে দেশে। পাখির বাংলা নাম: ‘পাতি চখাচখি’, ইংরেজি নাম: ‘কমন শেল ডাক’ (Common Shelduck), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘টাডোর্না টাডোর্না’, (Tadorna tadorna) গোত্রের নাম: ‘আনাটিদি’। অনেকে ‘শাহ চখা বা সাচ্কা’ নামেও ডাকে। দেশে দুই প্রজাতির চখাচখি নজরে পড়ে। যথা: খয়রা চখাচখি ও পাতি চখাচখি। এরা লম্বায় ৫৮-৬৭ সেন্টিমিটার। ওজন ১ কেজি। কপাল, মাথা ও গলা ধাতব সবুজ। ঠোঁট রক্ত লাল, গোড়া স্ফীত লাল পুঁটলি। বুক ও ঘাড়ে সাদার ওপর পাটকিলে চওড়া বন্ধনী। পিঠ ধবধবে সাদা। ডানা কুচকুচে কালো। লেজ ও কোমর সাদা। দেহতল ধবধবে সাদা। চোখ বাদামি। পা ও পায়ের পাতা মেটে-লাল। স্ত্রী-পুরুষ পাখি চেহারা ও আকার ভিন্ন। পুরুষের চেয়ে স্ত্রী পাখি খানিকটা ছোট। এ ছাড়াও স্ত্রী পাখির বুকে পাটকিলে বর্ণের প্রান্তটা কালো। অপ্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে মাথার তালু, গলার পেছন ও পিট কালচে-বাদামি। প্রধান খাবার: জলজ কীট, ছোট শামুক, চিংড়ি, ধান, শৈবাল, কেঁচো, সরীসৃপ ইত্যাদি। প্রজনন মৌসুম মে-জুন। মধ্য এশিয়ার পাহাড়ের খাড়া দেয়ালে প্রাকৃতিক ফাটলে কিংবা মাটির প্রাকৃতিক গর্তে পালক দিয়ে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ৬-১০টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৮-৩০ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 18/04/2014
লাল কপাল ছাতারে | Rufous fronted Babbler | Stachyris rufifrons
লাল কপাল ছাতারে | ছবি: ইন্টারনেট আবাসিক পাখি। প্রাকৃতিক আবাসস্থল আর্দ্র নিম্নভূমির বন, ঘাসবন ও বাঁশবন। ভূপৃষ্ঠ থেকে ২১০০ মিটার উঁচুতেও দেখা মেলে। খোলা বনবাদাড়ে অল্পবিস্তর নজরে পড়ে। সুশ্রী গোবেচারা টাইপ চেহারা। বিশেষ করে কপালের লাল চওড়া টান চেহারায় বৈচিত্র্যতা এনেছে। অনেকটাই সিঁদুর রাঙা মনে হয়। স্বভাবে হিংস নয়। এরা চঞ্চল ও অস্থিরমতির হলেও বেশ সামাজিক। বিপদে-আপদে কেউ কাউকে ছেড়ে চলে যায় না। সহমর্মিতা দেখায়। শত্রুর উপস্থিতি নজরে এলে একে অপরকে হুঁশিয়ার করে। এদের গানের গলা ভালো। জোড়ায় জোড়ায় বিচরণ করে। কোনো কোনো সময় ৫-৬টি পাখির ছোট দলও দেখা যায়। এরা মূলত বেশিরভাগই বাঁশবন এলাকায় বিচরণ করে। এ ছাড়াও শনবন, ঘাসবন ও নলখাগড়ার বনেও বিচরণ রয়েছে। বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান, মিয়ানমার, চীন, লাওস, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ড পর্যন্ত। প্রজাতিটি বিশ্বব্যাপী হুমকি নয়। পাখির বাংলা নাম: ‘লাল কপাল ছাতারে’, ইংরেজি নাম: ‘রুফাস-ফ্রন্টেড ব্যবলার’ (Rufous-fronted Babbler), বৈজ্ঞানিক নাম: Stachyris rufifrons | এরা দৈর্ঘ্যে ১১-১২ সেন্টিমিটার। ওজন ৯-১২ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। কপালে লালচে টান। মাথা ও ঘাড় বাদামি। ডানার প্রান্ত পালক ও লেজ গাঢ় বাদামি। দেহের তুলনায় লেজ খানিকটা লম্বা। দেহতল বাদামির ওপর হলদে আভা। চোখের মনি বাদামি। ঠোঁট ত্বক-গোলাপি। পা ত্বক-হলদে। প্রধান খাবার: শুঁয়োপোকা, গোবরেপোকা ও অন্যান্য কীটপতঙ্গ। ছোট ফল-ফলাদির প্রতিও আসক্তি রয়েছে। প্রজনন মৌসুম ফেব্রুয়ারি থেকে আগস্ট। ভূপৃষ্ঠ থেকে এক মিটারের মধ্যে গাছ-গাছালিতে বাসা বাঁধে। বিশেষ করে বাঁশবন, ঘাসবন কিংবা লতাগুল্মের ভেতর কাপ অথবা অর্ধ গম্বুজ আকৃতির বাসা বানায়। ডিম পাড়ে ৩-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৪-১৬ দিন। লেখক: আলমশাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 03/11/2017