ফিঙে | Black Drongo | Dicrurus macrocercus
ফিঙে | ছবি: ইন্টারনেট পক্ষীকুলের সমাজপতিরা একবার ‘পাখিরাজ’ নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছে। নির্বাচন পদ্ধতি হচ্ছে যে পাখি যত ওপরে উঠতে পারবে সে হবে তাদের রাজা। ঘোষণা অনুযায়ী পাখিরা একদিন আকাশে ডানা মেলল। মূলত চিল, বাজ, শকুন নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। ছোট পাখিদের মধ্যে ফিঙের সাধ জেগেছে আকাশে ওড়ার, সমস্যা হচ্ছে সে এত ওপরে উঠতে পারছে না। বিষয়টা মাথায় ঢুকতেই ওর মনে কূটবুদ্ধি এলো। ফিঙেটা চুপিচুপি চিলের পিঠে সওয়ার হলো। টের পায়নি তা চিল। চিল অন্য সব পাখিকে ছাড়িয়ে সবচেয়ে ওপরে উঠেছে এক সময়। আশপাশে তাকিয়েছিল যখন নিশ্চিত হয়েছে আর কেউ অত ওপরে উঠতে পারেনি, তখন সে নিচে নামতে শুরু করল। আর সেই সুযোগেই ফিঙে চিলের পিঠ ছেড়ে আরেকধাপ ওপরে উঠে গেল। কর্তৃপক্ষ দেখেছে ফিঙের অবস্থানই সবার ওপরে। সঙ্গে সঙ্গে ঘোষণা এসেছে ‘আজ থেকে পাখিদের রাজা ফিঙে’। হ্যাঁ, ফিঙে খুবই সাহসী পাখি। চিল, বাজ, শকুনকেও ছেড়ে কথা বলে না। ওদের নাগালের মধ্যে এলেই ঠুকরিয়ে দেয়। বাসার কাছে গেলে মানুষকে পর্যন্ত আক্রমণ করে। ছোট পাখিরা ওদের অবস্থানের কাছাকাছি বাসা বেঁধে নিরাপদে থাকে তাই। পাখিটার বাংলা নাম: ‘ফিঙে’, ইংরেজি নাম: ‘ব্ল্যাক ড্রোঙ্গো’, (Black Drongo), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘ডিক্রুরাস মেক্রোসারকাস’(Dicrurus macrocercus)। এ পাখি লম্বায় লেজসহ ২৮-৩১ সেন্টিমিটার। মাথা থেকে লেজের প্রান্ত পর্যন্ত কালো পালকে আবৃত। কালোর ওপরে নীলাভ আভা বের হওয়াতে পালিশ করা চকচকে দেখায়। এদের ঠোঁট ধাতব কালো, গোড়ায় সাদা ফোঁটা থাকে। অপ্রাপ্ত বয়স্কদের পেটের ওপর থাকে সাদা রেখা। যা দূর থেকে আঁশটে দেখায়। পা কালচে। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। প্রধান খাবার: কীটপতঙ্গ, ফুলের মধু টিকটিকি, প্রজাপতি, ভীমরুল, কেঁচো ইত্যাদি। প্রজনন সময় মার্চ থেকে জুন। গাছের তেডালের ফাঁকে বাটি আকৃতির বাসা বানায়। বাসা বানাতে উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে পশুর পশম, সরু লতা-ঘাস ইত্যাদি। ডিম পাড়ে ৩-৪টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৪-১৫ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 29/06/2013
আমুর শাহিন | Amur Falcon | Falco amurensis
আমুর শাহিন | ছবি: ইন্টারনেট পাখির নাম ‘আমুর শাহিন’। আমুরল্যান্ডে বিচরণ আধিক্য বিধায় হয়তো এই নাম ওদের। এরা উপমহাদেশে পরিযায়ী হয়ে আসে। সুদর্শন, স্লিম গড়নের পাখি। দেখতে কিছুটা ককাটিল পাখিদের মতো। পুরুষদের চেহারা চকচকে হলেও স্ত্রী পাখি খানিকটা নিষ্প্রভ; ভিন্ন বর্ণের। প্রাকৃতিক আবাসস্থল খোলা মাঠপ্রান্তর, খোলা বনাঞ্চল। শিকারি পাখি হলেও স্বভাবে হিংস নয়। একাকী, জোড়ায় কিংবা ছোট দলে বিচরণ করে। বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, আমুরল্যান্ড, ট্রান্সবিকালিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব সাইবেরিয়া, উত্তর-পূর্ব মঙ্গোলিয়া উত্তর-পূর্ব চীন, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, উত্তর কোরিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা পর্যন্ত। বিশ্বে এদের অবস্থান তত সন্তোষজনক নয়, উদ্বেগ প্রজাতি হিসেবে আইসিইউএন এদের শনাক্ত করেছে তাই। প্রজাতির বাংলা নাম: ‘আমুর শাহিন ’, ইংরেজি নাম: ‘আমুর ফ্যালকন’, (Amur Falcon), বৈজ্ঞানিক নাম: Falco amurensis | এরা ‘লালপা তুরমুতি’ নামেও পরিচিত। প্রজাতির গড় দৈর্ঘ্য ৩০-৩৬ সেন্টিমিটার। প্রসারিত ডানা ৬৫-৭৫ সেন্টিমিটার। ওজন ৯৭-১৫৫ গ্রাম। পুরুষের তুলনায় স্ত্রী পাখি খানিকটা বড়। চেহারায় বিস্তর তফাৎ। পুরুষ পাখির মাথা, ঘাড়, পিঠ ও লেজ গাঢ় ধূসর। ডানা খানিকটা লম্বা। দেহতল ধূসর। বুকের নিচ থেকে লেজতল পর্যন্ত লাল। চোখের বলয় কমলা হলুদ। ঠোঁটের অগ্রভাগ কালচে বাঁকানো, গোড়া কমলা হলুদ। পা লালচে কমলা। অপরদিকে স্ত্রী পাখির চেহারা ভিন্ন। শরীরে ধূসর, হলুদ, সাদা, বাদামির মিশ্রণ ছিট। বাদবাকি পুরুষের মতো। প্রধান খাবার: ঘাসফড়িং, পতঙ্গ, ছোট পাখি ও ছোট সরীসৃপ। প্রজনন মৌসুম মে থেকে জুন। গাছের উঁচু ডালে চিকন ডালপালা দিয়ে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ৩-৪টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৮-৩০ দিন। মাস খানেকের মধ্যেই শাবক স্বাবলম্বী হয় এবং বাবা-মাকে ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়। লেখক: আলম শাইন।কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 06/10/2017
পাতি বাটান | Common Sandpiper | Actitis hypoleucos
পাতি বাটান | ছবি: ইবার্ড পান্থপরিযায়ী পাখি। প্রজাতির অনেকে পরিযায়ী হয়ে এসে দীর্ঘ সময় কাটিয়ে দেয় আমাদের দেশে। এরা উত্তর ও পূর্ব এশিয়া থেকে পরিযায়ী হয়ে আসে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। এ প্রজাতির পাখিরা অতি সুলভ দর্শন। পরিচিতও বটে। বিশেষ করে সুন্দরবন এবং উপকূলীয় অঞ্চলে প্রচুরসংখ্যক সাক্ষাৎ মেলে। এছাড়াও হাওর-বাঁওড় এলাকায় ব্যাপক বিচরণ রয়েছে। দেশের একজন বিশিষ্ট পাখি বিশারদ জানিয়েছেন, এদের বিচরণ রয়েছে রাজধানী শহরের গুলশান লেকের কাছেও। এ প্রজাতির পাখি বেশিরভাগই একাকী বিচরণ করে, আবার ছোট দলেও দেখা যায়। প্রায় সারাদিনই নদী কিংবা সমুদ্রতটে ছুটে বেড়ায়। ঢেউয়ের তোড়ে জলজ পোকামাকড় কিনারে আচড়ে পড়লে তা খেয়ে নেয়। আর জল ঘেঁষে ঘন ঘন লেজ নেড়ে মাথা ঝাঁকিয়ে হাঁটতে থাকে। তবে এরা যাই করুক না কেন লক্ষ্য কিন্তু একটাই থাকে ওদের, আর তা হচ্ছে শিকারের খোঁজ নেয়া। মোটামুটি শান্ত প্রকৃতির পাখি। অযথা চেঁচামেচি করে না। সময় সুযোগ বুঝে সুরেলা কণ্ঠে ‘হুইট..হুইট.. কিটি হুইট..কিটি হুইট..’ সুরে ডাকে। আমি অনেকবার এদের সাক্ষা’ পেয়েছি উপকূলীয় অঞ্চলে, শুনেছি সুরেলা কণ্ঠও। আমার ছেলে আলম রাইন ওদের ভিডিও চিত্র ধারণও করেছে একাধিকবার। সময় পেলে মাঝে মাঝে দেখি ওসব বাবা-ছেলে মিলে। এ পাখির বাংলা নাম: ‘পাতি বাটান’, ইংরেজি নাম: ‘কমন স্যান্ডপাইপার’ (Common Sandpiper), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘একটাইটিস হাইপোলিউকস’ (Actitis hypoleucos), গোত্রের নাম: ‘স্কোলোপাসিদি’। এরা চাপাখি বা ছোট বালুবাটান নামেও পরিচিত। লম্বায় ১৮-২০ সেন্টিমিটার। মাথা ও ঘাড় ধূসরাভ বাদামির ওপর ডোরা দাগ। থুতনি ও গলা সাদা। চোখের ওপরের দিকেও রয়েছে সরু সাদা টান। দেহের উপরাংশ গাঢ় ধূসর। নিতম্ব বাদামি। পিঠ ও ডানার ওপর সরু আড়াআড়ি লাইন। বুকের নিচ থেকে বাকি অংশ সাদা। ঠোঁট কালচে। পা সবুজাভ হলুদ। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম। প্রধান খাবার: জলজ পোকামাকড়। মানুষের ফেলে দেয়া রুটি-বিস্কুট খায় এরা। প্রজনন মৌসুম মে থেকে জুন। বাসা বাঁধে লাডাখ, গাড়োয়াল ও কাশ্মীর অঞ্চলের ৩২০০ মিটার উচ্চতায় পাথুরে এলাকায়। বাসা বানাতে উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে শুকনো লতাপাতা। ডিম পাড়ে ৩-৪টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২২-২৫ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।
ক্ষুদে ঘুঘু | Little brown dove | Streptopelia senegalensis
ক্ষুদে ঘুঘু | ছবি: ইন্টারনেট সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে দেখা যাওয়ার নজির নেই। ইতিপূর্বে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগে মাত্র দুই-তিনবার দেখা যাওয়ার তথ্য রয়েছে। ফলে এরা স্থানীয় নাকি পরিযায়ী প্রজাতির তা নিশ্চিতভাবে নিরূপণ করা যায়নি। বলা যায় অতি বিরল দর্শন ‘ক্ষুদে ঘুঘু’। দেখতে অনেকটাই তিলা ঘুঘুর মতো। কণ্ঠস্বরও সেরকম। সুরে মাদকতা রয়েছে। বারবার শুনতে ইচ্ছে করে। চেহারা কবুতর আদলের। দেখতে মায়াবী। স্বভাবে শান্ত। পারতপক্ষে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হয় না। বিচরণ করে মাঠে-ঘাটে। তবে সেটি অবশ্য শুষ্ক শস্যভূমি হতে হবে। ভেজা বা স্যাঁতসেঁতে এলাকা এদের একদম অপছন্দ। জলপান ব্যতিরেকে জলাশয়ের কাছে ঘেঁষে না। গোসল করে নিয়মিত। তবে গায়ে জলের পরিবর্তে ধূলি ছিটিয়ে গোসল করে। খাদ্যের সন্ধানে বের হয় জোড়ায় কিংবা ছোট দলে। প্রজনন মৌসুমে পুরুষ পাখির হাঁকডাক বেড়ে যায়। তখন ‘কুকু..ক্রো..ক্রো..’ সুরে ডেকে স্ত্রী পাখিকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে। বাংলাদেশ ছাড়া এদের বৈশ্বিক বিস্তৃতি পূর্ব ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইসরাইল, লেবানন, সিরিয়া, তুরস্ক, সংযুক্ত আরব অমিরাত, সৌদি আরব, ইরান পর্যন্ত। আফ্রিকা অঞ্চলেও দেখা যায়। তুলনামূলক এদের আবাসস্থল কিছুটা মরুময় এলাকায়। পাখির বাংলা নাম: ‘ক্ষুদে ঘুঘু’, ইংরেজি নাম: ‘লিটল ব্রাউন ডাভ’ (Little brown dove), বৈজ্ঞানিক নাম: Streptopelia senegalensis | ইংরেজিতে এরা খধঁমযরহম উড়াব নামেও পরিচিত। দৈর্ঘ্য কমবেশি ২৬-২৭ সেন্টিমিটার। মাথা ও ঘাড় গোলাপি-বাদামি। পিঠ বালু মিশ্রিত বাদামি বর্ণ। লেজের বাইরের পালক সাদা। লেজের গোড়া ও কাঁধের পালক ধূসর। ডানার প্রান্ত পালক কালো। ওড়ার পালক কালো। বুক গোলাপি-বাদামি। পেট বালু মিশ্রিত বাদামি। চোখ বাদামি কালো। ঠোঁট শিং কালো। পা গোলাপি লাল। নখর কালো। প্রধান খাবার: শস্যবীজ, ঘাসের কচি ডগা ও মাটি। মাঝেমধ্যে উইপোকা খেতে যায়। প্রজনন মৌসুম নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। গাছের তেডালে অথবা দালানের ফাঁকে খড়কুটা দিয়ে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ১-২টি। স্ত্রী-পুরুষ উভয়ে পালা করে ডিমে তা দেয়। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৩-১৫ দিন। শাবক সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে উড়তে শেখে। লেখক: আলম শাইন, কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 10/07/2015
কালো কুক্কুট | Black coot | Fulica atra
কালো কুক্কুট | ছবি: ইন্টারনেট অতি সুলভ দর্শন পরিযায়ী পাখি ‘কালো কুক্কুট’। স্থায়ী নিবাস উত্তর এশিয়া ও হিমালয় অঞ্চলে। যখন প্রচণ্ড শীতে নিজ বাসভূমে খাদ্য সংকট দেখা দেয় কেবল তখনই আমাদের দেশে চলে আসে খাদ্যের সন্ধানে। শুধু খাদ্যের সন্ধানেই নয়, উষ্ণতার প্রয়াজনেও এ দেশে আশ্রয় নেয় ওরা। আশ্রয় নেয় সুপেয় জলের জলাশয়ে। হাওর-বাঁওড়, বিল-ঝিল এবং মোহনা অঞ্চলে হাজার হাজার পাখি একত্রে বিচরণ করে। এতদাঞ্চল ছাড়াও শীতে এদের দেশের বিভিন্ন স্থানেই দেখা মেলে। দেখা মেলে ঢাকা চিড়িয়াখানার লেকেও। মূলত জলচর পাখি এরা। হাঁসের মতো চট করে উড়তে পারে না। ওড়ার প্রস্তুতি নিতে হয় জলের ওপর খানিকটা কসরত করে। অত্যন্ত নিরীহ গোত্রের পাখি এরা। পারতপক্ষে নিজেদের ভেতর ঝগড়ায় লিপ্ত হয় না। সুখবরটি হচ্ছে শিকারিদের হাতে খুব বেশি ধৃত হয় না কালো কুক্কুট। প্রধান কারণটি হচ্ছে এদের মাংস তেমন সুস্বাদু নয়। যার কারণে প্রজাতিটি কিছুটা রক্ষা পাচ্ছে বলা যায়। তবে এদের প্রধান শত্র“ ঈগল গোত্রের পাখি। খোলা হাওর-বাঁওড়ে যখন ঝাঁকে ঝাঁকে কালো কুক্কুট বিচরণ করে বেখেয়ালি হয়ে ঠিক তখনই সুযোগটি কাজে লাগায় শিকারি পাখিরা। ওপর থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে শক্ত ধারালো নখর বিঁধিয়ে দেয় ওদের পিঠে। তথাপিও প্রজাতিটি বাংলাদেশে বিপন্মুক্ত। এটি আমাদের জন্য সুখবরই বটে। প্রতিটি প্রজাতি দেশে এমনি করে বিপন্মুক্ত হলে আমাদের জন্য সেটি হতো মহা আনন্দের। পাখির বাংলা নাম: ‘কালো কুক্কুট’, ইংরেজি নাম: ‘ব্ল্যাক কুট অথবা কমন কুট’, (Black coot/Common coot), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘ফুলিকা আত্রা’ (Fulica atra). গোত্রের নাম: রাললিদি’। এরা ‘জল কুক্কুট’ ও ‘পাতি কুট’ নামে পরিচিত। লম্বায় ৪২ সেন্টিমিটার। মাথা, ঘাড় কুচকুচে কালো। পিঠ কালচে ধূসর। খাটো লেজ গাঢ় কালো। ডানার প্রান্ত সামান্য সাদা। চোখ টকটকে লাল। ঠোঁট ত্রিকোণাকৃতির। ঠোঁটের গোড়ায় রয়েছে নীলাভ-সফেদ বর্ম। পা সবুজাভ। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। প্রধান খাবার ধান, জলজ উদ্ভিদের কচি ডগা, জলজ কীট। মাঝে মধ্যে ছোট মাছ খেতে দেখা যায়। প্রজনন মৌসুম গ্রীষ্মকালে। বাসা বাঁধে ভাসমান জলজ উদ্ভিদের ওপর লতাপাতা বিছিয়ে। ডিম পাড়ে ৬-১০টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২০-২১ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 21/03/2014
সোনালি পিঠ কাঠঠোকরা | Greater Flameback | Chrysocolaptes lucidus
সোনালি পিঠ কাঠঠোকরা | ছবি: ইন্টারনেট দেশের সুলভ দর্শন আবাসিক পাখি। দেহটা বাহারি রঙের পালকে আবৃত হলেও চোখের দিকে তাকালে ভয়ঙ্কর দর্শন মনে হয়। অনেকটা চোর বদমায়েশের মতো। প্রজাতিটির দেখা মেলে সর্বত্রই। এর মধ্যে চিরসবুজ বন, পাতাঝরা বন, প্যারাবন এবং লোকালয়ের আশপাশের বনবাদাড়ে বেশি দেখা মেলে। বিচরণ করে একা কিংবা জোড়ায় জোড়ায়। কখনো কখনো পারিবারিক দলেও দেখা যায়। মাটিতে নামে না খুব একটা। গাছের কাণ্ড বেয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে ওপরে ওঠে। পোকা আক্রান্ত অথবা মরা গাছের কাণ্ডে শক্ত ঠোঁটের দ্বারা আঘাত করে শিকার খোঁজে। এরা কষ্টসহিষ্ণু পাখি। রুক্ষ পরিবেশেও টিকে থাকতে পারে। প্রজনন মৌসুমে পুরুষ পাখি গাছের ফাঁপা ডালে আঘাত করে আর ধাতব কণ্ঠে ডেকে ওঠে, ‘কি-কি-কি-কি-কি…’ সুরে। হঠাৎ আওয়াজটা কানে গেলে পিলে চমকে ওঠে যে কারোই। গভীর বনাঞ্চলে এদের আওয়াজ প্রতিধ্বনি হয়ে ভৌতিক সুরে রূপ নেয়। বাংলাদেশ ছাড়াও এদের দেখা মেলে ভারত, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, চীন, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়াসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে। প্রজাতিটি বিশ্বে বিপন্মুক্ত। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে সংরক্ষিত। দেশে এদের শত্রুর সংখ্যা নগণ্য। পাখির বাংলা নাম: ‘সোনালি পিঠ কাঠঠোকরা’, ইংরেজি নাম: ‘গ্রেটার ফ্লেমব্যাক’ (Greater Flameback), বৈজ্ঞানিক নাম: Chrysocolaptes lucidus| বাংলাদেশে মোট ২০ প্রজাতির কাঠঠোকরার সাক্ষাৎ মেলে। লম্বায় ৩৩ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখির মধ্যে যথেষ্ট তফাৎ রয়েছে। পুরুষ পাখির মাথায় লাল পালকের খাড়া ঝুঁটি। যা দূর থেকে লাল রুমি টুপির মতো দেখায়। সাদা গালে সরু কালোরেখা। চওড়া কালোটান ঠোঁটের গোড়া থেকে শুরু করে ঘাড় অবধি ঠেকেছে। পিঠ ও ডানার রং সোনালি-জলপাই হলুদ। লেজ কালো, লেজের নিন্মাংশ লাল। দেহতল নিষ্প্রভ সাদার ওপর সরু কালো টান। অপরদিকে স্ত্রী পাখির মাথার ঝুঁটি কালো-সাদা বুটিদার। উভয়ের চোখের বলয় হলুদ, ঠোঁট নীলচে বাদামি। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখি দেখতে অনেকটাই স্ত্রী পাখিদের মতো। প্রধান খাবার: গাছের বাকলের নিচের অথবা মরা কাণ্ডের ভেতরের পোকামাকড় এবং গাছ পিঁপড়া। ফুলের মধুর প্রতি আসক্তি লক্ষ্য করা যায়। প্রজনন মৌসুম মার্চ থেকে জুলাই। গাছের মরা কাণ্ডে নিজেরা গর্ত খুঁড়ে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ৪-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৪-১৫ দিন। শাবক সাবলম্বী হতে সময় লাগে দিন পঁচিশেকের মতো। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 03/10/2014
মরিচা কপাল ডোরাডানা | Rusty fronted Barwing | Actinodura egertoni
মরিচা কপাল ডোরাডানা | ছবি: ইন্টারনেট মাথায় চমৎকার ঝুঁটি। দেহের তুলনায় লেজ খানিকটা লম্বা। দেখতে বুলবুলি পাখির মতো মনে হতে পারে। আসলে এরা বুলবুলি প্রজাতির কেউ নয়। প্রজাতিটি দেশের স্থায়ী বাসিন্দা হলেও যত্রতত্র দেখা যায় না। প্রাকৃতিক আবাসস্থল নাতিশীতোষ্ণ এলাকার ক্রান্তীয় আর্দ্র পার্বত্য অরণ্য। এ ছাড়া লতাগুল্মের ঝোপ কিংবা সুঁচালো চিরহরিৎ বনে বিচরণ রয়েছে। এরা একাকি বিচরণ করে না বললেই চলে। ছোট দলে বিচরণ করে। দলে কমপক্ষে ৬ থেকে ১২টি পাখি দেখা যায়। শুধু প্রজনন মৌসুমে দলত্যাগ করে জোড়ায় জোড়ায় বিচরণ করে। এদের চেহারা রাগীরাগী হলেও স্বভাবে হিংস নয়। দলের সবাই একত্রে বা মিলেমিশে থাকতে পছন্দ করে। বাংলাদেশ ছাড়া বৈশ্বিক বিস্তৃতি উত্তর-পূর্ব ভারত, নেপাল (হিমালয়ের পাদদেশ), ভুটান, পশ্চিম মিয়ানমার, চীন (ইউনান) পর্যন্ত। বিশ্বে এদের অবস্থান খুব বেশি সন্তোষজনক নয় বিধায় আইইউসিএন প্রজাতিটিকে ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। পাখির বাংলা নাম: ‘মরিচা কপাল ডোরাডানা’, ইংরেজি নাম: ‘রাস্টি ফ্রন্টেড বারউইং’ (Rusty-fronted Barwing), বৈজ্ঞানিক নাম: Actinodura egertoni | এরা ‘লালমুখ দাগিডানা’ নামেও পরিচিত। প্রজাতিটি দৈর্ঘ্যে ২২-২৪ সেন্টিমিটার। ওজন ৩৩-৩৮ গ্রাম। কপাল মরিচা লাল। মাথা ও ঝুঁটি ডার্ক-বাদামি। পিঠ পাটকিলে। ডানা পাটকিলের সঙ্গে সাদা-কালো মিশ্র ডোরাদাগ। লেজ পাটকিলে হলেও অগ্রভাগ কালচে, নিচের পালকের অগ্রভাগ সাদা। থুতনি মরিচা-লাল। দেহতল বাদামি-ধূসর। ঠোঁট খাটো হলদেটে ত্বক বর্ণ। পা ত্বক বর্ণের। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারায় তেমন কোনো পার্থক্য নেই। প্রধান খাবার: পোকামাকড়, ফড়িং, বীজ, কচিপাতা। ছোট ফলের প্রতিও আসক্তি রয়েছে। প্রজনন মৌসুম এপ্রিল থেকে জুলাই। ভূমি থেকে ৬ মিটার উচ্চতার মধ্যে কাপ আকৃতির বাসা বাঁধে। বাসা বাঁধতে উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে শুকনো ঘাস-লতা, শৈবাল, ফার্ন, শিকড় ইত্যাদি। ডিম পাড়ে ২-৪টি। ডিম ফুটতে কত দিন সময় লাগে সে তথ্য জানা যায়নি। লেখক: আলমশাইন।কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণীবিশারদওপরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 09/12/2016