বেঘবৌ | Lineated barbet | Megalaima lineata
বেঘবৌ | ছবি: ইন্টারনেট আমাদের দেশীয় পাখি এরা। দেশের গ্রামে-গঞ্জে এমনকি শহরেও এদের দেখা যায়। ঢাকা শহরেও এ পাখির বিচরণ রয়েছে। তবে এরা বেশিরভাগই জোড়ায় জোড়ায় থাকে। এলাকাভেদে সাধারণত এক বা দু’জোড়ার বেশি থাকে না। পশ্চিমবঙ্গেও এদের দেখা যায়। এরা ‘বসন্ত বাউরি’ পাখির জ্ঞাতি ভাই। চেহারা-সুরতও অনেকটা তেমনই। আচার-আচরণেও মিল রয়েছে বেশ খানিকটা। ডাকে ‘ক্রুয়ো-ক্রুয়ো-ক্রুয়ো’ সুরে। অনেক দূর থেকে আওয়াজটা শোনা যায়। সুরটা শুনতে মন্দ লাগে না; আর্তনাদের মতো কানে বাজে। আমি প্রথম দেখেছি মুন্সীগঞ্জ জেলার নগর কসবা এলাকায় বছর দশেক আগে। পাখিটাকে প্রথম দেখায় বসন্ত বাউরি ভেবে ভুল করেছি। দেখেছি একটা মরা গাছের খোড়লের ভেতর। মাথাটা সামান্য বের করে রেখেছে। অনেকটাই সাপের মাথার মতো লেগেছে দেখতে। ভয়ও পেয়েছি সামান্য। ভয়ের কারণ ছিল ওর বড় বড় চোখ দুটি। খোড়লের ভেতর থেকে মাথাটা ঘুরিয়ে আগে চারপাশটা দেখে নিয়েছে সে। আশপাশ নিরাপদ মনে হতেই লাফিয়ে সামনের ডালে বসেছে। ওই পাখিটা বের হতেই পেছন দিয়ে অন্য পাখিটি খোড়লে ঢুকে পড়েছে। বুঝতে পেরেছি, ডিমে তা দিতেই পালা করে ওরা খোড়লে ঢুকেছে। তখনো যে ডিম ফোটেনি, তা নিশ্চিত হয়েছি দু’ঠোঁটের ফাঁকে খাবার জাতীয় কিছু না দেখে। শাবক থাকলে অবশ্য খাবার নিয়েই কোটরে প্রবেশ করতে হতো। ওদের সেদিন দীর্ঘক্ষণ লাগিয়েই পর্যবেক্ষণ করেছি। যতদূর দেখেছি ওরা উড়তে তেমন পারদর্শী নয়। ডানা ঝাপটে এক গাছ থেকে অন্য গাছে গেলেও মনে হচ্ছে বুঝি নিচে পড়ে যাচ্ছে। অথবা পড়তে পড়তে গিয়ে অন্য গাছের ডালে বসছে। আমি আড়ালে দাঁড়িয়ে দুর্লভ কিছু দৃশ্য ভিডিও করেছিÑযা পরে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে কাজে দিতে পারে। পাখিটার বাংলা নাম: বেঘবৌ, ইংরেজি নাম: লাইনিয়েটেড বারবেট (Lineated barbet), বৈজ্ঞানিক নাম: মেগালাইমা লিনিয়েটা (Megalaima lineata)। এদের আরেক নাম ‘গোরখুদ’। এ পাখি লম্বায় ২৭-২৮ সেন্টিমিটার। এদের পিঠ, ডানা থেকে লেজ পর্যন্ত ঘাড় সবুজ বর্ণ। মাথা, ঘাড়, বুকের শেষাংশ পর্যন্ত খাড়া বাদামি ডোরা, যা থেকে হলুদের আভা বের হয়। চোখ বড়। চোখের বলয় হলুদ। চঞ্চু মোটা মজবুত, ধারালো। চঞ্চুর গোড়ায় ক’টি খাড়া লোম রয়েছে। পা হলুদ। বেঘবৌদের প্রিয় খাবার যে কোনো ধরনের ছোট রসালো ফল। তবে আতা, কামরাঙ্গা, নুন ফলের প্রতি অসক্তি বেশি। খাদ্য সংকটে এদের টমেটো খেতেও দেখা যায়। সুযোগ পেলে বেঘবৌ খেজুরের রসেও ভাগ বসায়। প্রজনন সময় গ্রীষ্মকাল। এরা নিজেরাই মরা গাছের গায়ে খোড়ল বানিয়ে বাসা বাঁধে। অনেক সময় যৎসামান্য খড়কুটা খোড়লের ঢুকিয়ে বাসাটাকে আরামদায়ক করে নেয়। ডিম পাড়ে ২-৪টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৩-১৫দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 28/12/2012
ধূসর কোকিল | Grey-bellied Cuckoo | Cacomantis passerinus
ধূসর কোকিল | ছবি: ইন্টারনেট বিরল দর্শন আবাসিক পাখি। দেখতে জ্ঞাতি ভাই কোকিলের মতো হলেও রং ভিন্ন এবং আকারেও খাটো। বিচরণ করে খোলা মাঠ প্রান্তরে, খোলা বনভূমির উঁচু গাছ-গাছালিতে এবং উঁচু ঝোপজঙ্গলে। একাকী কিংবা জোড়ায় জোড়ায় শিকারে বের হয়। আসলে এরা ঘটা করে শিকারে বের হয় না। মিয়া-বিবি উড়ে উড়ে পোকামাকড় বা কীটপতঙ্গ ধরে খায়। সব সময় হাঁকডাক করা এদের পছন্দ নয়। কেবলমাত্র প্রজনন মৌসুমে হাঁকডাক বেড়ে যায়। এ সময় পুরুষ পাখি মেঘাচ্ছন্ন দিনে, ভোরের দিকে, গোধূলিলগ্নে এবং পূর্ণিমার রাতে শোকাতুর সুরে ‘টীর টীর টীর পীপিপি পিউয়ী’ কণ্ঠে ডাকতে থাকে। প্রজাতিটিকে দেশে তেমন একটা দেখা যাওয়ার নজির নেই। সিলেট, চট্টগ্রাম ও খুলনা বিভাগে এক সময় অনিয়মিতভাবে দেখা গেছে। সর্বশেষ উনিশ শতকের দিকে ঢাকা বিভাগের বনাঞ্চলে দেখা যাওয়ার রেকর্ড রয়েছে। সূত্রমতে জানা যায়, এদের বৈশ্বিক বিস্তৃতি দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে। বিশেষ করে ভারত, শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ চীন এবং ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত। বিশ্বে প্রজাতিটি বিপন্মুক্ত। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে এরা সংরক্ষিত। পাখির বাংলা নাম: ‘ধূসর কোকিল’, ইংরেজি নাম: ‘গ্রে-বেলিড কুক্কু’, (Grey-bellied Cuckoo), বৈজ্ঞানিক নাম: Cacomantis passerinus | এরা ‘মেটেপেট পাপিয়া’ নামেও পরিচিত। লম্বায় ২৩ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখির মধ্যে তফাত রয়েছে। সামান্য অংশ বাদে পুরুষ পাখির দেহের উপরের দিক কালচে ধূসর রঙের। ওড়ার পালকও কালচে ধূসর। লেজ কালচে ধূসর হলেও অগ্রভাগ সাদা। লেজের নিচের দিকে সাদা ডোরা। দেহের নিন্মাংশ পীতাভ-সাদা। পাপিয়াদের মতো স্ত্রী পাখির চেহারা সাধারণত দু’ধরনের হয়। যেমন পুরুষ পাখিদের মতো এবং কলজে রঙের চেহারারও হয়। এদের পিঠ কালো ডোরাসহ লালচে-বাদামি। গলা ও বুক কালোর ওপর ঢেউ ঢেউ। দেহতল লালচে। উভয় পাখির ঠোঁট শিং কালো। চোখ বাদামি। পা ও পায়ের পাতা বাদামি-হলুদ। অপ্রাপ্তবয়স্কদের দেখতে কলচে রঙের। প্রধান খাবার: নরম পোকামাকড়। লোমশ শুঁয়োপোকার প্রতি আসক্তি বেশি। প্রজনন মৌসুম জুন থেকে সেপ্টেম্বর। নিজেরা বাসা বাঁধতে জানে না। বড় ফুটকি বা প্রিনা পাখির বাসায় ডিম পাড়ে। ডিম কত দিনে ফোটে তার সঠিক হিসাব নেই। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 09/09/2015
তিলা মুনিয়া | Spotted munia | Lonchura punctulata
তিলা মুনিয়া | ছবি: ইন্টারনেট অতিপরিচিত পাখি এরা। দেখতেও বেশ সুন্দর। প্রকৃতিতে বিচরণের চেয়ে আজকাল ওদের বেশি দেখা যায় খাঁচায় বন্দি অবস্থায়। যে কোনো পাখির দোকানে গেলেই ওদের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। ‘কিরিটি চিরিটি চিট্টি-কিট্টি-কিটরি… কিচ কিচ’ সুরে ডাকাডাকি করে আকুতি জানায় মুক্ত আকাশে উড়ে বেড়াতে। কিন্তু দোকানির মন গলে না তাতে। সে বড়োজোর হাত বদল করতে রাজি, খাঁচার দরজা খুলে চিরতরে মুক্ত করে দিতে নারাজ। কারণ দোকানি এর পেছনে লগ্নি করেছে। পাখিশিকারিদের দাদন দিয়েছে; বিনিময়ে শিকারিরা দেশের গ্রামাঞ্চল, জলা-জঙ্গল কিংবা দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল থেকে ফাঁদ পেতে পাখি শিকার করে দোকানির কাছে সরবরাহ করে। সব ধরনের পাখিই তারা শিকার করে। এর মধ্যে এ পাখিই বেশি ওদের ফাঁদে পড়ে। এর অন্যতম কারণ এরা বাস করে দলবদ্ধভাবে। জালের ফাঁদ পাতলে প্রায় পুরো ঝাঁকই ধরা পড়ে যায়। খুব সহজেই ধরা পড়ে বিধায় এ পাখি মোটামুটি দামেও সস্তা। তাই ওদের প্রতি দোকানি এবং ক্রেতার আগ্রহ বরাবরই একটু বেশি থাকে। উপরে উল্লিখিত পাখির বাংলা নাম: ‘তিলা মুনিয়া’। ইংরেজি নাম: “স্পটেড মুনিয়া” (Spotted munia), বৈজ্ঞানিক নাম: লনচুরা পাংকটুল্যাটা (Lonchura punctulata)। গোত্রের নাম পাসেরিদি। আমাদের দেশে যে ক’প্রজাতির মুনিয়া বেশি দেখা যায়, ওরা হচ্ছে কালোমাথা মুনিয়া, সাদাগলা মুনিয়া, সাদাপিঠ মুনিয়া, তিলা মুনিয়া ও লাল মুনিয়া। মুনিয়া প্রজাতির মধ্যে লাল মুনিয়াই সবচেয়ে বেশি সুন্দর। তিলা মুনিয়া লম্বায় ১১-১২ সেন্টিমিটার। মাথা, চিবুক, গলা, ঘাড় কালচে বাদামি। পিঠ চকোলেট-পাটকিলে। বুক-পেট হালকা হলুদাভের ওপর কালো বৃত্তের ভেতর সাদা ছিট ছিট দাগ। তলপেটের দিকে ছিট বা কোনো ধরনের দাগ নেই। লেজের উপরের গোড়ার দিক হলুদাভ। তলার দিকটা সাদাটে। ত্রিকোণাকৃতির ঠোঁটটি নীলচে কালো। পা কালচে। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম। পাখিবিশারদ ছাড়া সর্বসাধারণের পক্ষে স্ত্রী-পুরুষ নির্ণয় করা কঠিন। মুনিয়ারা মাটিতে নেমে হাঁটতে পারে না। চড়–ই পখির মতো লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটে। বাস করে দলবদ্ধভাবে গাছের ডালে বসে জোড়ায় জোড়ায়, গায়ের সঙ্গে গা মিলিয়ে। দৃশ্যটি দেখার মতো বটে। সব ধরনের মুনিয়ার খাবার ধান, কাউন ও শস্যবীজ। এরা খোসা ছিলে শস্যদানা খায়। প্রজনন সময় জুলাই থেকে অক্টোবর। কাঁটাঝোপ, কাশবন অথবা নল-খাগড়ার বনে এরা বাসা বাঁধতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। শুকনো খড়, লতাপাতা বাসা তৈরির উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে। ডিমের সংখ্যা ৪-৬টি। তা দেয় স্ত্রী-পুরুষ মিলে। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হতে সময় লাগে ১৪-১৭ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 19/10/2012
পাতি পাপিয়া | Common Cuckoo | Cuculus canorus
পাতি পাপিয়া | ছবি: ইন্টারনেট বিরল দর্শন পরিযায়ী পাখি। শুধুমাত্র গ্রীষ্মে পরিযায়ী হয়ে আসে বাংলাদেশে। মাঝে মধ্যে শরৎ এবং বসন্তকালে দেখা যাওয়ার নজির রয়েছে। সমগ্র দেশে দেখা না গেলেও ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও সিলেট বিভাগের বনাঞ্চলে দেখা যাওয়ার তথ্য রয়েছে। সাধারণত এরা চিরসবুজ বন অথবা আর্দ্র পাতাঝরা বনে বিচরণ করে। এছাড়াও পর্বতের পাদদেশে তৃণভূমিতে পোকামাকড় খুঁজে বেড়ায়। বনের গাছ-গাছালির উঁচু ডালে নিজেদের আড়াল করে রাখে। বেশিরভাগ সময় একাকী বিচরণ করে। ভোরে এবং গোধূলিলগ্নে কর্মচঞ্চলতা বেড়ে যায়। স্বভাবে কিছুটা লাজুক। প্রজনন মৌসুমে পুরুষ পাখির হাঁকডাক বেড়ে যায়। স্ত্রী পাখিকে আকৃষ্ট করতে ‘কুক-কু…কুক-কু..’ সুরে ডাকতে থাকে। স্ত্রী পাখি ডাকে সাড়া দেয় ‘হুয়িহুয়িহুয়ি..’ সুরে। বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত (সমস্ত ভারতে বিচরণ রয়েছে) এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপ পর্যন্ত। বিশ্বে বিপদমুক্ত। বাংলাদেশে এদের অবস্থান মোটেও সন্তোষজনক নয়। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে প্রজাতিটি সংরক্ষিত। পাখির বাংলা নাম: ‘পাতি পাপিয়া’, ইংরেজি নাম: ‘কমন কুক্কু’ (Common Cuckoo), বৈজ্ঞানিক নাম: Cuculus canorus | এরা ‘গায়ক কোকিল’ নামেও পরিচিত। প্রজাতির দৈর্ঘ্য কম বেশি ৩৩ সেন্টিমিটার। ওজন ৯০ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারা ভিন্ন। পুরুষ পাখির থুতনি, গলা ফ্যাকাশে ছাই রঙের। পিঠ ধূসর। বুক ফ্যাকাশে ছাই। পেট সাদা। লেজের নিচের কোর্ভাটের ওপর কালো সরু ডোরা। লেজ কালচে-বাদামি। লেজের প্রান্ত পালক সাদা। অপরদিকে স্ত্রী পাখির চেহারা দু’ধরনের। একটি কলিজা রঙের। পিঠ কালচে-বাদামি ডোরা এবং দেহতল কালচে ডোরা। অন্যটির চেহারায় ধূসর, বুকের নিচে লালচে। এছাড়া পুরুষ পাখির সঙ্গে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। উভয়ের ঠোঁটের গোড়া হলদে এবং ডগা শিং-বাদামি। চোখ হলুদ। পা ও পায়ের পাতা কমলা-হলুদ। অপ্রাপ্তবয়স্কদের ঘাড়ের পেছন দিকে সাদা চিতি এবং পালকে সাদা পাড়। প্রধান খাবার: লোমশ শুঁয়োপোকা ও অন্যান্য পোকামাকড়। প্রজনন মৌসুম মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর। হিমালয় ও সাইবেরিয়াঞ্চলে ডিম পাড়ে। নিজেরা বাসা বাঁধতে জানে না। ডিম পাড়ে তুলিকা, খঞ্জন, জাড়ফিদ্দা ও চটকের বাসায়। পালক মাতাদের অগোচরে মিনিট খানেকের মধ্যেই ডিম পেড়ে পালিয়ে যায়। সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে এরা খুব সহজে পালক মাতার ডিমের সঙ্গে নিজেদের ডিমের রঙ মিলিয়ে পাড়তে পারে। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 15/05/2015
নাকতা হাঁস | Knob billed duck | Sarkidiornis melanotos
নাকতা হাঁস | ছবি: ইন্টারনেট বাংলাদেশের প্রাক্তন আবাসিক পাখি। হালে এরা পরিযায়ী হয়ে আসে আমাদের দেশে। তবে সংখ্যায় একেবারেই নগণ্য। বলা যায় বিরল দর্শন। অথচ একটা সময়ে এ দেশের স্থায়ী বাসিন্দা ছিল এরা। শীতে বর্তমানে সিলেট বিভাগের আর্দ্রভূমি এবং হাওর এলাকায় কিছু নজরে পড়ে। শুধু প্রজনন সংকটের কারণে ‘নাকতা হাঁস’ এ দেশ থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। মূলত এরা বাদাভূমি বা নলবন এলাকার বাসিন্দা। বিচরণ করে পারিবারিক দলে। দলে প্রায় ৭০-৮০টি পাখি দেখা যায়। অগভীর জলাশয়ে সাঁতরিয়ে শিকার খোঁজে। মাথা ডুবিয়ে খাবার সংগ্রহ করে। বিপদ সংকেত পেলে জলে ডুবাতে থাকে। বেগতিক দেখলে গাছের ডালে গিয়ে বসে। এরা তেমন হাঁকডাকে অভ্যস্ত নয়। প্রজনন মুহূর্তে পুরুষ পাখি নিচু স্বরে ব্যাঙের মতো ডাকাডাকি করে। বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এদের বৈশ্বিক বিস্তৃতি রয়েছে। দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা ছাড়াও এদের দেখা যায় ভারত উপমহাদেশের বিভিন্ন এলাকায়। প্রজাতিটি বিশ্বে বিপন্মুক্ত। বাংলাদেশে মহাবিপন্ন হিসেবে বিবেচিত হয়েছে এবং বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে প্রজাতিটি সংরক্ষিতও রয়েছে। পাখির বাংলা নাম: ‘নাকতা হাঁস’, ইংরেজি নাম: Knob-billed duck, বৈজ্ঞানিক নাম: Sarkidiornis melanotos| এরা ‘বোঁচা হাঁস’ নামেও পরিচিত। প্রজাতিটি লম্বায় ৫৬-৭৬ সেন্টিমিটার। ওজন ২.২ কেজি। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারায় ও আকারে পার্থক্য রয়েছে। পুরুষ পাখির মাথা ও গলা সাদা। গলায় সাদার ওপর ছোট ছোট কালো তিলা। ঠোঁট কালো। ঠোঁটের গোড়ায় স্ফীত মাংসের কালো লতিকা। পিঠ দেখতে কালো মনে হলেও আসলে তা নীলাভ। পিঠ থেকে সবুজ-বেগুনি আভা বের হয়। ডানা কালচে। দেহতল সাদাটে। অন্যদিকে স্ত্রী পাখি আকারে খানিকটা ছোট। পিঠে অনুজ্জ্বল ছিটানো বাদামি ফোঁটা। ঠোঁটের গোড়ায় স্ফীত মাংসের লতিকা নেই। উভয় পাখির ঠোঁট কালো ও পায়ের পাতা ফ্যাকাসে। অপ্রাপ্তবয়স্কদের দেহের উপরাংশ অনুজ্জ্বল, দেহতল লালচে-বাদামি। প্রধান খাবার: শস্যবীজ, ছোট ব্যাঙ, জলজ পোকা-মাকড়, জলজ উদ্ভিদের কচি ডগা। প্রজনন মৌসুম জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর। জলাশয়ের কাছাকাছি পুরনো গাছের প্রাকৃতিক কোটরে বাসা বাঁধে। বাসা বাঁধতে উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে চিকন ডালপালা, ঘাস, শুকনো পাতা ও পালক। ডিম পাড়ে ১০-১৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৭-৩০ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 27/06/2014
পাকড়া কাঠঠোকরা | Fulvous breasted woodpecker | Dendrocopos macei
পাকড়া কাঠঠোকরা | ছবি: ইন্টারনেট সুলভ দর্শন আবাসিক পাখি ‘পাকড়া কাঠঠোকরা’। দৃষ্টিনন্দন চেহারা। প্রজাতির অন্যদের মতো চোখ ভয়ঙ্কর দর্শন নয়। নেই খাড়া ঝুঁটিও। দেখা মেলে যত্রতত্র। গ্রাম-গঞ্জের পাশাপাশি শহরেও নজরে পড়ে। নজরে পড়ে রাজধানীতেও। বিচরণ করে খোলামেলা বনবনানী কিংবা লোকালয়ের গাছগাছালিতে। এমনকি কোলাহলপূর্ণ রাস্তার পাশে গাছেও লাফাতে দেখা যায়। এরা সুযোগ পেলেই গাছের গায়ে কুঠারের মতো শক্ত চঞ্চু চালিয়ে ওদের অবস্থান জানান দেয়। খাদ্যের সন্ধান ব্যতিরেকেও স্বভাবসুলভ আচরণগত কারণে গাছের গায়ে কুঠার চালিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে দেয়। শিকারের সন্ধান পেলে জোরে জোরে চেঁচিয়ে ওঠে ‘পিক…পিক…’ সুরে। বিচরণ করে একাকী কিংবা জোড়ায় জোড়ায়। অনেক সময় পরিবারের সবাই মিলে গাছে লাফিয়ে বেড়ায়। প্রজাতির অন্যদের মতোই এরাও গাছের কাণ্ডে লাফিয়ে লাফিয়ে খাড়া হাঁটে। পারতপক্ষে মাটি স্পর্শ করে না। প্রজনন মৌসুমে পুরুষ পাখি ঘাড় দুলিয়ে স্ত্রী পাখির দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে। বাংলাদেশ ছাড়াও এদের বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত, নেপাল, পাকিস্তান, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, লাওস, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল। প্রজাতিটি বিশ্বে বিপদমুক্ত। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে সংরক্ষিত। দেশে এদের সংখ্যা সন্তোষজনক। পাখির বাংলা নাম: ‘পাকড়া কাঠঠোকরা’, ইংরেজি নাম: ‘ফালভাস-ব্রেস্টেড উডপেকার’(Fulvous-breasted woodpecker) বৈজ্ঞানিক নাম: Dendrocopos macei | এরা ‘বাতাবি কাঠঠোকরা’ এবং ‘জরদ কাঠঠোকরা’ নামেও পরিচিত। লম্বায় ১৯ সেন্টিমিটার। ওজন ৪৫ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষ পাখির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। পুরুষ পাখির মাথার চাঁদি লাল। কাঁধ ফ্যাকাসে, কাঁধ ঢাকনি কালো। চোখ ও ঘাড়ের মধ্যখানে কালো ডোরা। পিঠ এবং ডানায় সাদা-কালো ডোরা। লেজের আচ্ছাদক কালো, নিন্মাংশ উজ্জ্বল লাল। গলা ফ্যাকাসে লাল-বাদামি। দেহতল ফ্যাকাসে লাল-বাদামির ওপর কালচে সরু ডোরা। চোখ বাদামি। ঠোঁটের উপরের অংশ শিঙ-বাদামি, নিচের অংশ ফ্যাকাসে স্নেট। পা ও পায়ের পাতা সবুজাভ স্নেট। স্ত্রী পাখির মাথার চাঁদি কালো। বাদবাকি পুরুষ পাখির মতোই। অপ্রাপ্ত বয়স্ক পাখির দেহবর্ণ ফ্যাকাসে। প্রধান খাবার: গাছ পিঁপড়া, এ ছাড়াও পিউপা, বিছাপোকা, পিঁপড়ার ডিম এবং ফুলের মধু খেতে দেখা যায়। প্রজনন মৌসুম এপ্রিল থেকে মে। নিজেরা গাছের কাণ্ডে গর্ত বানিয়ে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ৩-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৫-১৭ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 02/11/2018
সাদাটে মেঠো চিল | Pallid Harrier | Circus macrourus
সাদাটে মেঠো চিল | ছবি: ইন্টারনেট বিরল প্রজাতির ভবঘুরে পাখি। লম্বা পা, হলুদ গোলাকার চোখ ওদেরকে রাগী চেহারায় রূপ দিয়েছে। মূলত এরা হিংস্র নয়। বরং প্রজাতির অন্যদের তুলনায় দেখতে খানিকটা সুদর্শন। দেশে শীত মৌসুমে দেখা মেলে। উপমহাদেশীয় অঞ্চলে এরা মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত বিচরণ করে। বাংলাদেশ ছাড়া বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল। এছাড়াও মধ্য এশিয়া, পশ্চিম ইউরোপে এবং পূর্ব আফ্রিকায়ও দেখা মেলে। দেখা মেলে ফিনল্যান্ডেও। এদের বিচরণ ক্ষেত্র ধানক্ষেত, গমক্ষেত, উচুঁ বনভূমি, ছোট নদ-নদী, জলাশয়ের আশপাশ এবং মালভূমির ওপর পর্যন্ত। এরা ক্ষেত খামারের ওপর চক্কর দিয়ে শিকার খোঁজে। বিশ্বে এদের অবস্থান সন্তোষজনক নয়। মূলত শস্যক্ষেতে ব্যাপক কীটনাশক ব্যবহারের কারণে প্রজাতিটি হুমকির মুখে পড়েছে এবং প্রজননে বিঘœ ঘটছে। ফলে আইইউসিএন এদের ইতিমধ্যে লাল তালিকাভুক্ত করেছে। পাখির বাংলা নাম: ‘সাদাটে মেঠো চিল’, ইংরেজি নাম: ‘প্যালিড হ্যারিয়ার’ (Pallid Harrier), বৈজ্ঞানিক নাম: Circus macrourus| এরা ‘ধলা কাপাসি’ নামেও পরিচিত। প্রজাতিটি দৈর্ঘ্যে ৪০-৪৮ সেন্টিমিটার। প্রসারিত ডানা ৯৫-১২০ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখির মধ্যে খানিকটা তফাত রয়েছে। পুরুষের তুলনায় স্ত্রী পাখি আকারে বড় এবং গায়ের রংও ভিন্ন। পুরুষ পাখির গড় ওজন ৩১৫ গ্রাম, স্ত্রী পাখির গড় ওজন ৪৪৫ গ্রাম। পুরুষ পাখির মাথা সাদাটে ধূসর। পিঠ ধূসর। লেজের গোড়া ও অগ্রভাগ বাদামি-কালো। গাঢ় কালো রঙের ঠোঁটের অগ্রভাগ বড়শির মতো বাঁকানো। ঠোঁটের গোড়া হলুদ। চোখ উজ্জ্বল হলুদ, মণি কালো। পা ও পায়ের পাতা হলুদ, নখ কালো। অপরদিকে স্ত্রী পাখির গায়ের পালক মরিচা-বাদামি। দেহতল হালকা বাদামি সাদা। প্রধান খাবার: ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী, পাখি, ইঁদুর, বড় পোকামাকড়, ফড়িং ও পঙ্গপাল। প্রজনন সময় মে থেকে জুন। প্রজনন পরিসীমা দক্ষিণ রাশিয়া, ইউক্রেন, উত্তর-পশ্চিম চীন ও পশ্চিম মঙ্গোলিয়া পর্যন্ত। বাসা বাঁধে ঝোপের ভেতর, জলাভূমির কাছে মাটিতে অথবা ঘেসো ভূমিতে লম্বা ঘাস বিছিয়ে। ডিম পাড়ে ৪-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৮-৩০ দিন। শাবক ৩৫-৪৫ দিনের মধ্যে উড়তে শিখে। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 01/07/2016