সবুজ ঘুঘু | Asian Emerald Dove | Chalcophaps indica indica
সবুজ ঘুঘু | ছবি: ইন্টারনেট মুষলধারে বৃষ্টি, সঙ্গে শীলাপাত। বজ্র ‘কড়্..কড়্..কড়াৎ’ শব্দে চিৎকার জুড়ে দিয়েছে। কানে তুলো ঢুকিয়েও রেহাই পাইনি বিকট শব্দ থেকে। জীবজগতের প্রতিটি প্রাণীই আশ্রয় নিয়েছে নিজ নিজ আলয়ে। এমনিতে গোধূলিলগ্ন, তার ওপর ঝড়ের তাণ্ডব। পরিবেশটা কেমন জানি ভুতুড়ে ভুতুড়ে লাগছে। ঝড়ের গতি কিছুটা কমে আসতেই বেরিয়ে পড়লাম ছাতা নিয়ে। ঝড়ের ঝাপটায় ছাতাটা গুটিয়ে আসছে, তার পরও অভিযান থামিয়ে দেইনি। সোজা গিয়ে হাজির বাড়ির উত্তরের খালপাড়ে। তিন দিন আগে খালপাড়ের একটা আমগাছে ‘হলদে পাখি’র বাসা দেখেছি। ওটাতে ছোট দুটি শাবকও রয়েছে। বাসাটা ওরা জুতসই ডালে বাঁধেনি। বাতাসের ঝাপটায় বাচ্চাগুলো নিচে পড়লে আর রেহাই নেই। একেবারে গিয়ে পড়বে জলে। কাজেই দে ছুট। মিনিট চার-পাঁচেকের মধ্যেই গন্তব্যে পৌঁছলাম। গাছের ওপর তাকিয়ে স্বস্তিও পেলাম যাক প্রকৃতি ওদের কৃপা করছে; কিন্তু কৃপা করেনি ‘সবুজ ঘুঘু’ পাখিটাকে। বেচারি নিচে পড়ে কাতরাচ্ছে। হাত বাড়িয়ে ওকে তুলে নিলাম। রক্ত ঝরছে। ডানায় শীলের আঘাত লেগেছে। ডানাটা ভেঙে গেছে বোধহয়। পাখিটার করুণ দশা দেখে আমারও চোখের কোণায় জল জমেছে। আহ, কী সুন্দর পাখি! এমনিই তো এদের আজকাল খুব কম দেখা যায়। একটা সময় গ্রামেগঞ্জে প্রচুর সবুজ ঘুঘু দেখা যেত। ‘কু-উ’ বা ‘হুউন’ সুরে ডেকে মানুষকে আপ্লুত করে দিত। সেই চিরচেনা করুণ সুর আজকাল খুব কমই শোনা যায়। কারণ যেখানে সেখানে চোখে পড়ে না এখন আর। হয়তো ওদের বেঁঁঁঁচে থাকার পরিবেশ অনুকূলে নেই। তার ওপর যোগ হয়েছে পাখি নিধনকারীদের অত্যাচার। সব মিলিয়ে এরা অসহায় হয়ে পড়েছে। তাই ওকে বাঁচাতে মরিয়া হয়ে উঠলাম। বাড়ি এনে ডানায় ব্যান্ডেজ বেঁধে দিলাম। আমার দেয়া চিকিৎসায় পাখিটি সুস্থ হয়েছে এবং সুসংবাদটি হচ্ছে, সে মুক্ত আকাশে ডানাও মেলেছে। হ্যাঁ পাঠক, এ পাখিদের বাংলা নাম: ‘সবুজ ঘুঘু’। ইংরেজি নাম: ‘এশিয়ান এমারল্ড ডাভ’ (Asian Emerald Dove)। বৈজ্ঞানিক নাম: Chalcophaps indica indica | আমাদের দেশে বহু প্রজাতির ঘুঘু রয়েছে যেমন: তিলা ঘুঘু, সবুজ ঘুঘু, রাজ ঘুঘু, রাম ঘুঘু, খুদে ঘুঘু, লাল ঘুঘু ইত্যাদি। এরা লম্বায় ২৫-২৮ সেন্টিমিটার। এদের মাথা ও ঘাড় ধূসর। কাঁধ সাদা। পিঠ সবুজ। ডানার প্রান্ত এবং লেজ কালো। গলা থেকে তলপেট পর্যন্ত উজ্জ্বল গোলাপি। ঠোঁট ও পা লাল। স্ত্রী পাখি আকারে সামান্য ছোট। রঙে সামান্য তারতম্য রয়েছে। স্ত্রী পাখির মাথা ঘাড় বাদামি। কাঁধের সাদা দাগটি অস্পষ্ট। এদের প্রধান খাদ্য ধান ও অন্যান্য শস্যদানা। মাটিতে বিচরণকালে খুঁটে খুঁটে মাটি এবং উইপোকা খায়। প্রজনন সময় এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর। ভূমি থেকে ৫ মিটার উঁচুতে গাছের ডালে বাসা বাঁধে। সরু, নরম ও শুকনো ঘাস-লতা দিয়ে বাসা বানায়। ডিম পাড়ে ১-২টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৭-১৮ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 23/11/2012
সিঁদুরে ফুলঝুরি | Scarlet backed flowerpecker | Dicaeum cruentatum
সিঁদুরে ফুলঝুরি | ছবি: ইন্টারনেট সুলভ দর্শন আবাসিক পাখি ‘সিঁদুরে ফুলঝুরি’। শরীরে বাহারি রঙের পালক। চেহারা বেশ আকর্ষণীয়। এক কথায় সুদর্শন প্রজাতির পাখিদের কাতারে পড়ে ওরা। আকারে চড়ই পাখির চেয়েও খাটো। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় আর্দ্র নিুভূমির জঙ্গলে অথবা বৃক্ষাচ্ছাদিত এলাকায় বিচরণ করে। বাংলাদেশে যত্রতত্র নজরে পড়ে। বিশেষ করে গ্রামীণ বনাঞ্চলে বেশি দেখা যায়। দেখা যায় গেরস্তের সাজানো বাগানেও। অথবা বাড়ির আঙিনার লাউ-কুমড়া কিংবা ঝিঙেলতার ঝোপে নাচানাচি করতে দেখা যায়। অর্থাৎ যেখানে ফুল সেখানে ফুলঝুরি পাখির সমাহার। ফুলের মধু এদের প্রধান খাবার। মধুপানের নেশায় সারা দিন ব্যস্ত সময় পার করে। স্বভাবে ভারি চঞ্চল। অস্থিরমতি পাখি। কোথাও একদণ্ড বসে থাকার সময় নেই। ছোট গাছ-গাছালি কিংবা লতাগুল্মের ওপর লাফিয়ে লাফিয়ে শিস কাটে। মিষ্টি সুরে গান গায় ‘চিপ…চিপ… বা ঝিট…ঝিট…’ সুরে। সুর শুনতে মন্দ নয়। সিঁদুরে ফুলঝুরি পাখিদের বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, চীন, লাওস, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, ব্রুনাই, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর পর্যন্ত। বাংলাদেশে এদের অবস্থান সন্তোষজনক। ভূমি থেকে এদের বাসা কাছাকাছি বিধায় বিড়াল বা বনবিড়ালের আক্রমণের শিকারে পরিণত হয়। তথাপিও দেশে ভালো অবস্থানে রয়েছে ওরা। পাখির বাংলা নাম: ‘সিঁদুরে ফুলঝুরি’, ইংরেজি নাম: ‘স্কারলেট ব্যাকেট ফ্লাওয়ারপেকার’ (Scarlet-backed flowerpecker), বৈজ্ঞানিক নাম: Dicaeum cruentatum | এরা ‘লালপিঠ ফুলঝুরি’ নামেও পরিচিত। দৈর্ঘ্য কমবেশি ৭-৯ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারা ভিন্ন। পুরুষ পাখির কপাল থেকে শুরু করে ঘাড়ের মাঝ বরাবর সোজা পিঠ দিয়ে লেজ ঢাকনি পর্যন্ত সিঁদুরে লাল পালকে আবৃত। মাথার এবং ঘাড়ের দুপাশ ডানা এবং লেজ কালো। দেহের দুপাশ নীলাভ-ধূসর। দেহতল বাদামি-হলুদ। অপরদিকে স্ত্রী পাখির উপরের অংশ ধূসরাভ-বাদামি। নিতম্ব লাল। উভয়ের ঠোঁট ও পা কালো। প্রধান খাবার ফুলের মধু ও বিচি। প্রজনন মৌসুম ফেব্রুয়ারি-এপ্রিল। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। ভূমি থেকে দুই-আড়াই মিটার উঁচুতে গাছের ডালে অথবা গুল্মলতা আচ্ছাদিত ঝোপে ঝুলন্ত থলে আকৃতির বাসা বাঁধে। বাসা বানাতে উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে গাছের নরম তন্তু, তুলা, শ্যাওলা ইত্যাদি। ডিম পাড়ে ২-৩টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৪-১৫ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 21/12/2018
সুন্দরী প্রিনা | Graceful Prinia | Prinia gracilis
সুন্দরী প্রিনা | ছবি: ইন্টারনেট আবাসিক পাখি। স্লিম গড়ন। ভোলাভালা চেহারা। দেহের তুলনায় লেজ খানিকটা লম্বা। সাংঘাতিক চঞ্চল হলেও উড়তে খুব পারদর্শী নয়। দ্রুত উড়তে গেলে মনে হয় নিচে ঝুলে পড়বে। কিন্তু ভাবেসাবে দেখায় খুব উড়তে পারে। তবে এরা খুব আমুদে পাখি। সারাদিনই নেচেগেয়ে কাটাতে পছন্দ করে। খাদ্যের সন্ধানে গাছগাছালিতে হন্যে হয়ে ছুটে বেড়ায়। ছোট ছোট পোকামাকড় সংগ্রহ করে খায়। বেশিরভাগই একাকী বিচরণ করে। মূলত এরা ঘাসবনের পাখি। এ ছাড়াও শুষ্ক অঞ্চল, বিশেষ করে সারিবদ্ধ গাছপালা কিংবা কাঁটা গাছে বিচরণ রয়েছে। প্রজনন মৌসুমে জোড়ায় জোড়ায় দেখা যায়। কণ্ঠস্বর সুমধুর। ‘টিস..টিস..’ কণ্ঠে ডাকে। বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ ব্যতীত দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল। এ ছাড়াও মিসর, ইরাক, ইসরাইল, সোমালিয়া ও উত্তর-পূর্ব আফ্রিকা পর্যন্ত বিস্তৃতি রয়েছে। বিশ্বব্যাপী এরা হুমকি নয়, অবস্থান মোটামুটি সন্তোষজনক। পাখির বাংলা নাম: ‘সুন্দরী প্রিনা’| ইংরেজি নাম: ‘গ্রেসফুল প্রিনিয়া’, (Graceful Prinia) | বৈজ্ঞানিক নাম: Prinia gracilis| এরা ‘চটপটে বুনো টুনি’ নামেও পরিচিত। প্রজাতির গড় দৈর্ঘ্য ১০-১৩ সেন্টিমিটার। ওজন ৬-৮ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারা অভিন্ন হলেও পুরুষ পাখির রঙে সামান্য পার্থক্য রয়েছে। পুরুষ পাখি বাদামি রঙের। মাথা, ডানা ও লেজে গাঢ় বাদামি টান। গলা বাদামি সাদা। স্ত্রী পাখি হালকা বাদামি। উভয়ের লেজ লম্বা, কালচে বাদামি। দেহতল বাদামি-সাদা। ঠোঁট খাটো, গোলাপি কালচে। চোখ বাদামি। পা ও পায়ের পাতা হলুদাভ ত্বক বর্ণের। প্রজনন পালক ভিন্ন। প্রধান খাবার: গোবরে পোকা, কীটপতঙ্গ, পোকামাকড়। প্রজনন মৌসুম ফেব্রুয়ারি-জুলাই। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। ভূমি থেকে দুই-তিন মিটার উঁচুতে লতাপাতা পেঁচিয়ে থলে আকৃতির বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ৩-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১০-১১ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 30/03/2018
পাতারি হাঁস | Common teal | Anas crecca
পাতারি হাঁস | ছবি: ইন্টারনেট প্রচণ্ড শীতে সাইবেরিয়া থেকে পরিযায়ী হয়ে আসে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানে। শীতের শুরুতে লতাগুল্ম আচ্ছাদিত বৃহৎ জলাশয়ে কিংবা হাওর-বাওরে ঝাঁক বেঁধে বিচরণ করতে দেখা যায়। দেখা যায় জলাশয়ের ওপর ওড়াউড়ি করতেও। এদের ওড়ার গতিও ভালো। উড়তে উড়তে অনেক সময় পুরুষ পাখি নিচুস্বরে ডাকে ‘ক্রিট..ক্রিট’। প্রজাতিটি সুলভ দর্শন হলেও আমাদের দেশে এরা নিরাপদ নয়। বিশ্বে বিপদমুক্ত। বাংলাদেশের বন্য প্রাণী আইনে প্রজাতিটি সংরক্ষিত। গত দশক আগেও দেশে এদের ব্যাপক বিচরণ ছিল। সে তুলনায় বর্তমান সময়ে নজরে পড়ছে না তেমনটি। ১৯৯৭ সালের দিকেও ঢাকা চিড়িয়াখানার লেকে ব্যাপক দর্শনের নজির রয়েছে। দ্রুত এদের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ার প্রধান কারনটিই হচ্ছে শিকারিদের দৌরাত্ম্য। দেখতে ভীষণ সুন্দর, ওজনে সামান্য হলেও এরা রেহাই পায় না নিষ্ঠুর শিকারিদের হাত থেকে। রসনাবিলাসিরা যদি একটু সংযত হন বোধ করি দেশের শিকরিরাই বিপাকে পড়ে যাবে এবং তারা পাখি শিকারে নিরুৎসাহী হয়ে পড়বে। তাতে করে হ্রাস পাওয়া প্রজাতির সংখ্যা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকবে বলে আমাদের বিশ্বাস। এ পাখির বাংলা নাম: ‘পাতারি হাঁস’, ইংরেজি নাম: ‘কমন টিল’ (Common teal), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘আনাস ক্রেককা’ (Anas crecca)। এরা ‘পাতি তিলিহাঁস’ নামেও পরিচিত। লম্বায় ৩৪-৩৮ সেন্টিমিটার। ওজন ২৮০ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষ পাখির বর্ণে পার্থক্য রয়েছে। প্রজনন মৌসুমে পুরুষ পাখির রঙ বদলায়। এ সময় এদের মাথার রঙ লালচে-বাদামি এবং শরীরে গুঁড়ি গুঁড়ি রেখা দেখা যায়। মাথার দু’পাশে লম্বা দুটি সাদা ডোরা। চোখের ওপর থেকে ঘাড় পর্যন্ত দেখা যায় চওড়া ধাতব-সবুজ পট্টি। ডানা কালো, ধাতব সবুজ ও হলদেটে। লেজের নিচের পালক হলুদাভ ছোপ। স্ত্রী পাখির রূপ নিষ্প্রভ। মাথার তালু ও ঘাড় কালচে-লালচের মিশ্রণ। উভয়ের চোখ বাদামি। পা ও পায়ের পাতা জলপাই-ধূসর। অপ্রাপ্ত বয়স্ক পাখির সঙ্গে মা পাখির বর্ণের খানিকটা মিল রয়েছে। প্রধান খাবার: জলজ উদ্ভিদের কচিডগা ও বীজ। প্রজনন সময় এপ্রিল থেকে আগস্ট। জন্মভূমি সাইবেরিয়া অঞ্চলের জলাশয়ের পাশের ভূমিতে শুকনো লতাপাতা বিছিয়ে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ৮-১২টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২১-২৩ দিন। শাবক উড়তে শিখে ২৫-৩০ দিনের মধ্যেই। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 28/02/2014
পাটকিলে মাথা ছাতারে | Chestnut capped Babbler | Timalia pileata
পাটকিলে মাথা ছাতারে | ছবি: ইন্টারনেট আবাসিক পাখি। দেখতে চমৎকার। গ্রামীণ বনেবাদাড়ে অল্পবিস্তর নজরে পড়ে। সমগ্রবিশ্বে এদের অবস্থান খুব বেশি সন্তোষজনক নয়। বাংলাদেশ ছাড়াও বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত, নেপাল, মিয়ানমার, চীন, লাওস, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনাম পর্যন্ত। এরা বেশ সামাজিক পাখি। প্রজননকালীন জোড়ায় জোড়ায় বিচরণ করলেও ছোট দল দেখা যায়। রাত্র যাপনও করে দলবদ্ধভাবে। দলের একটি পাখি যে দিকে উড়ে যায় অন্যরাও সেদিকে উড়তে থাকে। আবার কেউ যদি পথ হারিয়ে ফেলে অন্যরা ডাকাডাকি করে তাকে পথ চিনিয়ে নিয়ে আসে। সবচেয়ে মজাদার বিষয়টি হচ্ছে এদের দলের কেউ ডিম-বাচ্চা ফুটালে শাবকদের যত্ন আত্তি দলের সবাই মিলেই করে। অনেক সময় দলের সবাই মিলে অন্যের ডিমে তা দিতে দেখা যায়। এরা মূলত জলাশয় এলাকায় বিচরণ করে। বিশেষ করে শনবন, নলখাগড়ার বনের ভেতর আড্ডা জমে ভালো। এদের গানের গলা বেশ সুমধুর। ভারি মিষ্টি সুরে গান গায়। প্রজাতিটি বিশ্বব্যাপী ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। আইইউসিএন প্রজাতিটিকে লাল তালিকাভুক্ত করেছে। পাখির বাংলা নাম: ‘পাটকিলে মাথা ছাতারে’, ইংরেজি নাম: ‘চেস্টনাট ক্যাপেড ব্যাবলার’ (Chestnut-capped Babbler), বৈজ্ঞানিক নাম: Timalia pileata | এরা ‘লালটুপি ছাতারে’ নামেও পরিচিত। এরা দৈর্ঘ্য ১৫-১৭ সেন্টিমিটার। ওজন ১৫-২৩ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। কপালে সাদা টান। মাথায় পাটকিলে অথবা মদ-বাদামি রঙের টুপি। থুঁতনি কালো। ঘাড়ে মালাসদৃশ ছাই ধূসর রেখা। পিঠ বাদামি। বাদামি লেজে কালচে ডোরা দাগ। দেহের তুলনায় লেজ খানিকটা লম্বা। গলা সাদা। পেট থেকে বস্তিপ্রদেশ পর্যন্ত হালকা বাদামি। লেজতল কালচে। চোখের মণি বাদামি। ঠোঁট নীলচে কালো। পা কালচে। প্রধান খাবার: শুঁয়োপোকা, গোবরেপোকা ও অন্যান্য কীট-পতঙ্গ। ছোট ফল-ফলাদি, খেজুরের রসের প্রতিও আসক্তি রয়েছে। প্রজনন মৌসুম এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুম হেরফের রয়েছে। জলাশয়ের কাছাকাছি ঘাসবন কিংবা লতাগুল্মের ভেতর ডিম্বাকৃতির বাসা বানায়। ডিম পাড়ে ৩-৪টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৪-১৬ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 04/03/2016
মেটে কাঠ ময়ূর | Grey Peacock Pheasant | Polyplectron bicalcaratum
মেটে কাঠ ময়ূর | ছবি: ইন্টারনেট বিরল দর্শন আবাসিক পাখি। চেহারা অন্যসব ময়ূরের মতো তত আকর্ষণীয় নয়। কালেভদ্রে দেখা মেলে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের চিরসবুজ অরণ্যে। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের বনে ১৯৭৮ সালেও দেখা গেছে। হালে দেখা যাওয়ার নজির নেই। বাংলাদেশ ছাড়াও প্রজাতির বিস্তৃতি ভারত, ভুটান, মিয়ানমার, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, লাওস, থাইল্যান্ড ও চীন পর্যন্ত। এতদাঞ্চলের আর্দ্র ঘন চিরসবুজ অরণ্য এদের প্রধান বিচরণ ক্ষেত্র। বনতলের ঝোপজঙ্গলে কিংবা বনপ্রান্তে এমনকি খোলা মাঠেও এরা বিচরণ করে। খাদ্যের সন্ধানে বের হয় সাধারণত জোড়ায় জোড়ায়। একাকী খুব কমই দেখা যায়। গৃহপালিত মোরগ-মুরগির মতো মাটিতে আঁচড় কেটে কীটপতঙ্গ বের করে খায়। খাদ্যের সন্ধান পেলে পুরুষ পাখি ‘অক-কক-কক-কক-’ সুরে আওয়াজ করে স্ত্রী পাখিকে কাছে ডেকে নিয়ে আসে। প্রজাতির সংখ্যা বিশ্বে সন্তোষজনক নয়। তবে গত কয়েক দশক ধরে এদের সংখ্যা হ্রাস পেলেও আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছায়নি। যার ফলে আইইউসিএন প্রজাতিটিকে ন্যূনতম বিপদযুক্ত বলে ঘোষণা দিয়েছে। এরা বাংলাদেশে মহাবিপন্নের তালিকায় স্থান পেয়েছে এবং বন্যপ্রাণী আইনে সংরক্ষিত রয়েছে। পাখির বাংলা নাম: ‘মেটে কাঠ ময়ূর’, ইংরেজি নাম: ‘গ্রে পিকক-ফেজেন্ট (Grey Peacock-Pheasant), বৈজ্ঞানিক নাম: Polyplectron bicalcaratum| এরা ‘মেটে কাঠমৌর’ নামেও পরিচিত। লম্বায় ৫৬ সেন্টিমিটার (লেজ ৩১ সেন্টিমিটার)। দেহের তুলনায় লেজ অনেক বড়। ওজন ৭৩০ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষ পাখির মধ্যে খানিকটা তফাৎ রয়েছে। পুরুষ পাখির মাথায় পীতাভ খাড়া পালক। ঘাড় বাদামি-পীতাভ। পিঠ ধূসর-বাদামি, তার ওপর বেগুনি-সবুজ চক্র যা লেজেও রয়েছে। থুতনি-গলা সাদাটে। দেহের নিন্মাংশে সাদা ডোরা। স্ত্রী পাখি আকারে সামান্য খাটো। এদের মাথার চুড়াও খাটো। ডানায় এবং লেজে অস্পষ্ট চক্র। উভয়ের চোখের চারপাশ হলুদাভ চামড়ায় আবৃত। ঠোঁট পীতাভ বর্ণের। ঠোঁটের অগ্রভাগ ও মধ্যভাগ কালো। পা ও পায়ের পাতা কালচে। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখি দেখতে স্ত্রী পাখিদের মতো। প্রধান খাবার: শস্যদানা, ফল, পোকামাকড় ও ছোট শামুক। প্রজনন মৌসুম মার্চ থেকে জুন। ঝোপের ভেতর মাটির প্রকৃতিক গর্তে নরম খড়কুটো দিয়ে বাসা বানায়। ডিম পাড়ে ২-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২১ দিন। ডিম ফুটে ছানা বের হয়েই মায়ের সঙ্গে খাবারের সন্ধানে ছুটে। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 24/10/2014
মরুর ফিদ্দা | Desert wheatear | Oenanthe deserti
মরুর ফিদ্দা | ছবি: ইন্টারনেট শরৎকালে পরিযায়ী হয়ে আসে মরু কিংবা রুক্ষ অঞ্চল থেকে। বৈশ্বিক বিস্তৃতি পশ্চিম সাহারা, মিসরের পশ্চিম অংশ, চীন, পাকিস্তানের বেলুচিস্তান, আফগানিস্তান, তুর্কিস্তান, দক্ষিণ ককেশাস, উত্তর মঙ্গোলীয়া, মরক্কো, ইরাক, ইরান, উত্তর আরব উপদ্বীপ ও উত্তর-পূর্ব আফ্রিকা। ইউরোপের কিছু কিছু অঞ্চলেও দেখা যায়। প্রজাতিটি তেমন বাহারি রঙের না হলেও দেখতে মন্দ নয়। গায়ের রং বালির মতো। বালির ওপর বিচরণকালীন দূর থেকে চেনা কঠিন হয়ে পড়ে। বিচরণ করে একাকী। জোড়ায়ও খুব বেশি দেখা যায়। হাঁটে লাফিয়ে লাফিয়ে। মরুময় কিংবা পাথুরে এলাকায় ঘুরেফিরে পোকামাকড় শিকার করে। তবে এদের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এরা যে কোনো রুক্ষ পরিবেশে অনায়াসে টিকে থাকতে পারে। তথাপিও বিশ্বে এদের অবস্থান সন্তোষজনক নয়। আইইউসিএন প্রজাতিটিকে লাল তালিকাভুক্ত করেছে ইতিমধ্যে। পাখির বাংলা নাম: ‘মরুর ফিদ্দা’, ইংরেজি নাম: ডেজার্ট হুইটইয়ার (Desert wheatear), বৈজ্ঞানিক নাম: Oenanthe deserti | এরা ‘ঊষর কানকালি’ নামেও পরিচিত। দৈর্ঘ্য কমবেশি ১৪-১৫ সেন্টিমিটার। ওজন ৩৪ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষ পাখির রঙে সামান্য পার্থক্য রয়েছে। গ্রীষ্মে পুরুষ পাখির মাথা ও ঘাড় ফ্যাকাসে। চিবুক, গলা ও কানের দু’পাশ কুচকুচে কালো, যা ঘাড়ের কাছাকাছি গিয়ে ঠেকেছে। পিঠ ফ্যাকাসে বাদামি। ডানার প্রান্ত পালকে কালো-সাদার মিশ্রণ। লেজের গোড়ার দিক ফ্যাকাসে বাদামি। লেজের পালক কালো। বুকের ওপর বাদামি-সাদা, দেহতল ফ্যাকাসে বাদামি। শীতে রং উজ্জ্বল হয়। স্ত্রী পাখির চিবুক, গলা ও কানের দু’পাশের কালো অংশের পরিবর্তে বালি বাদামি। পিঠ বালি বাদামি। ডানার প্রান্ত পালক ধূসর কালো। উভয়ের চোখ গাঢ় বাদামি। ঠোঁট ও পা কালো। প্রধান খাবার: শুঁয়োপোকা, গুবরেপোকা, মাছি, পিঁপড়াসহ অন্যান্য পোকামাকড়। এছাড়া শস্যবীজের প্রতি আসক্তি রয়েছে। প্রজনন মৌসুম এপ্রিল থেকে মে। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। বাসা বাঁধে পাথুরে পাহাড়ের ওপর। এ ছাড়াও চিরহরিৎ কাঁটাঝোঁপের ভেতরও সংসার পাতে। বাসা বানাতে উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে ঘাস, শিকড় ইত্যাদি। ডিম পাড়ে ৪-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৩-১৪ দিন। শাবক স্বাবলম্বী হতে সময় লাগে ২০-২১ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 23/10/2015