সাদা ডানা লালগির্দি | Daurian Redstart | Phoenicurus auroreus
সাদা ডানা লালগির্দি | ছবি: ইন্টারনেট শীতে পরিযায়ী হয়ে আসে। বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ, ভারত, চীন, মঙ্গোলিয়া, কোরিয়া, জাপান ও দক্ষিণ-পূর্ব রাশিয়া পর্যন্ত। প্রাকৃতিক আবাসস্থল নদ-নদীর কাছাকাছি ঘন ঝোপ-জঙ্গল। এরা দোয়েল আকৃতির পাখি। পুরুষ পাখি দেখতে ভীষণ সুন্দর। স্ত্রী পাখির চেহারা তত আকর্ষণীয় নয়। সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রজাতির মনে হয়। প্রজাতির কণ্ঠস্বর সুমধুর। এদের খাদ্য গ্রহণে বাছবিচার রয়েছে। যেমন গ্রীষ্মে পোকামাকড় এবং শীতে বীজ বা উদ্ভিজ খাবার খায়। সমগ্র বিশ্বে প্রজাতির অবস্থান তত সন্তোষজনক নয় বিধায় আইইউসিএন প্রজাতিটিকে ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত হিসেবে ঘোষণা করেছে। তবে প্রজাতিটি হুমকি নয়। পাখির বাংলা নাম: ‘সাদাডানা লালগির্দি’, ইংরেজি নাম: ‘ডাউরিয়ান রেডস্টার্ট’ (Daurian Redstart), বৈজ্ঞানিক নাম: Phoenicurus auroreus | এরা ‘ডাউরিয়ান গির্দি’ নামেও পরিচিত। প্রজাতির গড় দৈর্ঘ্য ১৪-১৫ সেন্টিমিটার। ওজন ১১-২০ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারায় বিস্তর তফাৎ। পুরুষ পাখির মাথা, গলা, ঘাড় ও পিঠ নীলাভ ধূসর। ডানা কালো, মধ্যখানে সাদা চওড়া টান। লেজে লালচে কমলার সঙ্গে নীলাভ কালচে পালক। দেহতল কমলা লালচে। চোখ নীলচে কালো। ঠোঁট ও পা নীলচে কালো। স্ত্রী পাখির মাথা, গলা ঘাড় ও পিঠ বাদামি-ধূসর। ডানার পালক কালচে ধূসর, মধ্যখানে সাদাটান। কোমর শেয়ালে লাল। দেহতল ধূসর কমলা। বাদ বাকি পুরুষের মতো। যুবাদের রং ভিন্ন। প্রধান খাবার: পোকামাকড়, ছোট ফল, বীজ ইত্যাদি। প্রজনন সাইবেরিয়া অঞ্চলে এপ্রিল-জুন। মঙ্গোলিয়া, তিব্বতে মে-আগস্ট। অন্যান্য স্থানেও প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। বাসা কাপ আকৃতির। বাসা বাঁধার উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে শুকনো ঘাস, শৈবাল, তন্তু আর সরু লতাপাতা। ডিম পাড়ে ২-৪টি। ফুটতে সময় লাগে সপ্তাহ দুয়েক। লেখক: আলমশাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 24/11/2017
গেছো চড়ই | Eurasian Tree Sparrow | Passer motanus
গেছো চড়ই | ছবি: ইন্টারনেট চেহারা হুবহু ‘পাতি চড়–ই’ অর্থাৎ আমাদের ঘরের আশপাশে যে চড়–ই দেখা যায় ওদের মতোই দেখতে। মাথার দিকে না তাকালে প্রজাতি শনাক্ত করা কঠিন। আবাসিক পাখি। বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, চীন, ফিলিপাইন, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, মাইক্রোনেশিয়া, তিউনিসিয়া, জিব্রাল্টার, মিশর, আলজেরিয়া, ইসরাইল ও দুবাই পর্যন্ত। প্রাকৃতিক আবাসস্থল কাঁটাওয়ালা চিরহরিৎ গুল্ম, খেজুর গাছ। এছাড়াও ফল বাগান এবং গৃহকোণে কমবেশি নজরে পড়ে। স্বভাবে ভারি চঞ্চল। ভয়ডর না থাকলেও পাতি চড়–ইদের মতো মানুষের অত কাছাকাছি আসে না। বিচরণ করে ঝাঁকে ঝাঁকে। ঝাঁক বেঁধে চলার কারণে বাজ পাখির শিকারে বেশি পরিণত এরা। তার ওপর ফসলের জমিতে কীটনাশক প্রয়োগের ফলেও জীবনহানি ঘটে ব্যাপক। তথাপিও ওরা বিশ্বে ভালো অবস্থানে রয়েছে। পাখির বাংলা নাম: ‘গেছো চড়ই’, ইংরেজি নাম:‘ইউরেশিয়ান ট্রি স্প্যারো ’(Eurasian Tree Sparrow), বৈজ্ঞানিক নাম: Passer motanus | এরা ‘লালচেমাথা চড়–ই’ বা ‘ইউরেশীয় গাছচড়–ই’ নামেও পরিচিত। প্রজাতি দৈর্ঘ্যে ১৪-১৫ সেন্টিমিটার। ওজন ১৭-৩০ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষ পাখির মধ্যে খানিকটা তফাৎ রয়েছে। পুরুষ পাখির মাথা বাদামি-লালচে। ঘাড় সাদা। ঘাড়ের দু’পাশ সাদা। পিঠ বাদামি। ডানায় বাদামি-কালো রেখার সংমিশ্রণ। ডানার গোড়ার দিকে সাদা পট্টি দেহতলের ময়লা সাদার সঙ্গে মিলিত হয়েছে। লেজ হালকা বাদামি। গলা ও থুতনি কালো। ঠোঁট কালো। স্ত্রী পাখির পিঠ ঝাপসা বাদামির ওপর খাড়া ডোরা। ডানায় সাদা পট্টি। দেহতল ফ্যাকাসে। ঠোঁট ত্বক বর্ণ। উভয়ের চোখ বাদামি। প্রধান খাবার: শস্যদানা। এ ছাড়াও পোকামাকড়, ঘাসের কচিডগা, ফুলের মধু ইত্যাদি খায়। প্রজনন মৌসুম এপ্রিল থেকে মে। বাসা বাঁধে দরদালান কিংবা গাছের ফাঁকফোকরে। ডিম পাড়ে ৪-৬টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১২-১৪ দিন। লেখক: আলমশাইন।কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 17/02/2017
ধূসর সারস | Demoiselle Crane | Anthropoides virgo
ধূসর সারস | ছবি: ইবার্ড বিপন্ন প্রজাতির পরিযায়ী পাখি। দেশে আগমন ঘটে শীতে। হিমালয় পাড়ি দিয়ে মাঝেমধ্যে সিলেটের হাওরাঞ্চলে উপস্থিত হয়। বিচরণ করে জলাশয়ের কাছাকাছি তৃণভূমি, কৃষি ক্ষেত, চারণভূমি, অগভীর আশ্রিত উপসাগরীয় অঞ্চল, নদী ও অগভীর হ্রদে। মাঝেমধ্যে হাঁটু পরিমাণ জলে নেমে খাবার খুঁজতে দেখা যায়। মরু অঞ্চলেও দেখা যাওয়ার নজির রয়েছে। খাদ্যের সন্ধানে বের হয় জোড়ায় অথবা বড়সড়ো ঝাঁকে। চলার পথে কারো ফসলের খেতে দলবেঁধে নামলে মুহূর্তেই ফসল তছনছ করে দেয়। প্রজনন মৌসুমে পুরুষ পাখি স্ত্রী পাখিকে আকৃষ্ট করতে নাচের কসরৎ দেখায়। এ সময় উভয়ে জোরে জোরে দ্বৈত সঙ্গীতের মতো গান গায়। প্রজাতির বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ ছাড়া ভারত, উত্তর-পূর্ব চীন, মঙ্গোলিয়া, তুরস্ক, পশ্চিম ইউরেশিয়া ও আফ্রিকা পর্যন্ত। সমগ্র বিশ্বে এদের অবস্থান সন্তোষজনক নয় বিধায় আইইউসিএন লাল তালিকাভুক্ত করেছে। বাংলাদেশে সঙ্কটাপন্ন বিপন্ন প্রজাতির তালিকায় রয়েছে ধূসর সারস। পাখির বাংলা নাম: ‘ধূসর সারস’, ইংরেজি নাম: ‘ডেমোজিল ক্রেন’, (Demoiselle Crane), বৈজ্ঞানিক নাম: Anthropoides virgo | দেশে তিন প্রজাতির পরিযায়ী সারস দেখা যায়। যথাক্রমে: দেশি সারস, পাতি সারস ও ধূসর সারস। গড় দৈর্ঘ্য ৮৫-৯০ সেন্টিমিটার। প্রশস্ত ডানা ১৫০-১৭০ সেন্টিমিটার। ওজন ২-৩ কেজি। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম। মাথার তালু ধূসর। মাথার পেছন থেকে কালো রঙ শুরু করে ঘাড়, থুঁতনি ও গলা হয়ে বুকের ওপর গিয়ে নিচে ঝুলে পড়েছে। চোখের পেছন থেকে সাদা পালক ঘাড়ের ওপর ঝুলে পড়েছে। সারা দেহ গাঢ় ধূসর। ওড়ার পালক কালো। লেজে সাদা-কালো লম্বা পালক, যা ঝুলে পড়েছে নিচে। দেহতল গাঢ় ধূসর। ঠোঁট সবুজাভ, ডগা হলুদ। কমলা-লাল রঙের চোখ দুটি আকারে ছোট। পা ও পায়ের পাতা ময়লা কালো। অপ্রাপ্তবয়স্কদের চেহারা ভিন্ন। প্রধান খাবার: শস্যবীজ, ঘাসবীজ, কন্দ, গাছের কচিডগা, ব্যাঙ, টিকটিকি, কাঁকড়া, কেঁচো, মাকড়সা, ছোট পাখি ও কীটপতঙ্গ। প্রজনন মৌসুম এপ্রিল থেকে মে। বাসা বাঁধে জলাশয়ের কাছাকাছি মাটির ওপরে। শুকনো চিকন ডালপালা, লতাপাতা উপকরণ হিসাবে ব্যবহার করে। ডিম পাড়ে ২টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৭-২৯ দিন। শাবক উড়তে শিখে ৬ সপ্তাহের মধ্যে। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 01/04/2016
মেঠো রাতচরা | Savanna Nightjar | Caprimulgus affinis
মেঠো রাতচরা | ছবি: ইন্টারনেট দেশের স্থায়ী বাসিন্দা হলেও যততত্র দেখা যায় না। তুলনামূলক পাথুরে এবং মজা এলাকায় বেশি নজরে পড়ে। এ ছাড়াও তৃণময় সমভূমি এলাকায় দেখা মেলে। প্রজনন মৌসুম ছাড়া বেশির ভাগই একাকী বিচরণ করে। দিনে ঘুমিয়ে কাটায়। সূর্যাস্তের খানিকটা পরেই ঝোপজঙ্গলের ভেতর থেকে ‘চিঙ্ক-চিঙ্ক-চিঙ্ক’ সুরে ডাকতে থাকে। কণ্ঠস্বর সুমধুর না হলেও সুরে তাল-লয় রয়েছে। রাত বাড়লে ডাকাডাকি বন্ধ। দেখতে মোটেও আকর্ষণীয় নয়। শারীরিক গড়নটাও একটু ব্যতিক্রম। গায়ের বর্ণ অনেকটাই গাছের মরা ডাল বা শুকনো পাতার মতো। গাছের ডালে বসলে খুব সহজে পাখি হিসেবে শনাক্ত করা যায় না। অপরদিকে মাটিতে বসে থাকলে শুকনো পাতার মতোই মনে হতে পারে। মাড়িয়ে গেলেও টের পাওয়া যায় না যে, এরা পাতা নাকি পাখি! বর্ণচোরা বিধায় নিরাপদে থাকার খানিকটা সুযোগ পায় ওরা। বাংলাদেশে প্রজাতিটি আবাস সংকটের কারণে অসুলভ হয়ে পড়েছে। আইইউসিএন এদের উদ্বেগ প্রজাতি হিসেবে লাল তালিকাভুক্ত করেছে। বিশ্বব্যাপী এরা হুমকির মুখে রয়েছে। বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ ছাড়া ভারত, পাকিস্তান, হিমালয় অঞ্চল, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনাম পর্যন্ত। পাখির বাংলা নাম: ‘মেঠো রাতচরা’, ইংরেজি নাম: ‘সাভানা নাইটজার’ (Savanna Nightjar), বৈজ্ঞানিক নাম: Caprimulgus affinis | দেশে মোট পাঁচ প্রজাতির ‘রাতচরা’ পাখির দেখা মেলে। দৈর্ঘ্য ২০-২৬ সেন্টিমিটার। পুরুষ পাখির ওজন ৫৪-৮৬ গ্রাম। স্ত্রী পাখির ৭৫-১১০ গ্রাম। উভয়ের গায়ের উপরের রং বাদামি-দারুচিনি মিশ্রিত ছিট এবং কালচে ডোরাকাঁটা। ঠোঁটের গোড়ায় অল্পসল্প খাড়া লোম। লেজ ও ডানা সামান্য লম্বা। বুক থেকে পেট পর্যন্ত রয়েছে আড়াআড়ি ডোরা দাগ। গলার নিচে হালকা ক্রিমসাদা ছিট। লেজ তলের পালকে বাদামি-সাদার ছিট। চোখ বাদামি। ঠোঁট কালচে, ওপরের ঠোঁট বড়শির মতো বাঁকানো। পা কালচে। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম মনে হলেও সামান্য পার্থক্য রয়েছে। প্রধান খাবার: ঝিঁঝিঁ পোকা, ফড়িং, গুবরে পোকা ও উড়ন্ত কীটপতঙ্গ। বিশেষ করে নিশাচর কীটপতঙ্গ শিকার করে বেশি। প্রজনন মৌসুম বাংলাদেশ-ভারত এপ্রিল থেকে আগস্ট। এছাড়াও অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। বাসা বাঁধে ছোট ছোট পাথর অথবা সরাসরি মাটির ওপরে। উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে শুকনো লতাপাতা। ডিমের সংখ্যা ২টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৪-১৬ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 18/12/2015
নীলকণ্ঠ বসন্তবউরি | Blue throated Barbet | Megalaima asiatica
নীলকণ্ঠ বসন্তবউরি | ছবি: ইন্টারনেট গত বসন্তে পাখিটাকে প্রথম দেখি রিকাবী বাজারের পূর্বপাড়ায়। মুন্সীগঞ্জ জেলার মিরকাদিম পৌরসভায় অবস্থিত বাজারটি। খানিকটা ঘনবসতি এলাকা। দালান-কোঠার ফাঁক-ফোকরে যৎসামান্য গাছ-গাছালি রয়েছে ওখানে। সে সুবাদে কিছু পাখ-পাখালির আড্ডাজমে এতদাঞ্চলে। এ পর্যন্ত বেশ ক’প্রজাতির পাখির সাক্ষাৎ পেয়েছি রিকাবী বাজারের আশপাশে। তম্নধ্যে এ পাখিটাই বেশি আমার দৃষ্টি কেড়ে নিতে সক্ষম হয়েছে। আতাগাছের পাতার আড়ালে বসে আতাফল ঠুঁকরিয়ে খাওয়া অবস্থায় ওকে আমি আবিষ্কার করি। আমাকে দেখে ও গাছের শীর্ষ শাখায় অবস্থান নেয়। মুখের খাবার ফেলে দিয়ে নিজেকে আড়াল করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বিষয়টা টের পেয়ে আমিও সটকে পড়ি। পাখিটা দেখতে যেমনি সুন্দর তেমনি গানের গলাও। তারপরও ওরা গায়ক পাখি হিসাবে স্বীকৃতি আদায় করতে পারেনি। গায় করুণ সুরে। তাল-লয়-ছন্দ মেনে গান গায়। ‘পুক্র্ক… পুক্র্ক… পুক্র্ক’ শব্দে ডাকে। পরপর তিনবার ডেকে দম নিয়ে পুনরায় অস্পষ্টভাবে ‘কুক্’ শব্দ করে। এরা একটানা বেশি সময় ধরে ডাকে না। থেমে থেমে ডাকে। ওদের গান শুনে মনে হয় বুঝি ওরা চিরদুঃখী। প্রকৃতপক্ষে তা নয়। সুখ-দুঃখে একই ধরনের সুরে ডাকে। তবে মজাদার বিষয় হচ্ছে ওদের সুর শুনা যায় কিন্তু সহজে দেখা যায় না। পাতার আড়ালে নিজেদেরকে লুকিয়ে রেখে গান গায়। গানের আওয়াজ প্রায় ৬০০-৬৫০ মিটার থেকেও শুনা যায়। এরা আমাদের দেশীয় প্রজাতির পাখি হলেও সহজে দেখা মেলে না, শুধুমাত্র বসন্তকালে এদের দেখা মেলে। এ সময়ে শুধু গ্রামেগঞ্জেই নয়, ঢাকা শহরের বিভিন্ন উদ্যানে প্রবেশ করলেও গাছের শীর্ষশাখা থেকে ওদের ডাক শুনা যায়। এদের গাছে বসার ভঙ্গিটা একটু ব্যতিক্রম। খাড়া হয়ে বসে। একটানা অনেকখানি পথ এরা উড়তে পারে না। উড়ন্ত অবস্থায় ভালো মতো পরখ করলে বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে যায়। মনে হয় উড়তে উড়তে বুঝি মাটিতে পড়ে যাচ্ছে। সুন্দর এ পাখির বাংলা নাম: ‘নীলকণ্ঠ বসন্তবউরি’ ইংরেজি নাম: ‘ব্লু-থ্রোটেড বারবেট,’ (Blue-throated Barbet), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘মেগালাইমা এশিয়াটিকা’ (Megalaima asiatica), গোত্রের নাম: ‘মেগালাইমিদি’। আমাদের দেশে মোট তিন ধরনের বসন্তবউরি দেখা যায়। যথা: বড় বসন্তবউরি, নীলকণ্ঠ বসন্তবউরি, ছোট বসন্তবউরি। এ পাখি লম্বায় ২১-২৩ সেন্টিমিটার। এদের কপাল ও ঘাড় সিঁদুর লাল। মাথার তালু কালচে। ঘাড়ের দু’পাশে দু’টো লালফোটা। মাথার নিচ থেকে গলা পর্যন্ত নীল। বুক থেকে লেজের গোড়া পর্যন্ত হলদেটে সবুজ। লেজের তলার প্রান্তটা নীলচে। পিঠ ঘাস-সবুজ। ডানা বুজানো অবস্থায় সবুজ। নিচে সাদা। ঠোঁট মোটা ত্রিকোনাকৃতির। ঠোঁটের গোড়ায় অল্পক’টি খাঁড়া লোম। চোখের মনি কমলা রঙের বৃত্তদ্বারা আবৃত। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম। সব ধরনের বসন্তবউরিদের প্রিয় খাবারই হচ্ছে ছোট ছোট ফল-ফলাদি। প্রজনন সময় মার্চ থেকে জুলাই। গাছের কোটরে বাসা বাঁধে। পছন্দসই গাছ খুঁজতে ৩-৪দিন সময় লেগে যায়। ডিম পাড়ে ২-৩টি। ডিমের বর্ণ সাদা। স্ত্রী-পুরুষ উভয়ে পালা করে ডিমে তা দেয়। ফুটতে সময় লাগে ১৭-২২ দিন। শাবক উড়তে শেখে ২৫-২৮দিনে। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 05/10/2012
নীলাভবুক বটেরা | Blue Breasted Quail | Coturnix chinensis
নীলাভবুক বটেরা | ছবি: ইন্টারনেট বিরল দর্শন আবাসিক পাখি। নাদুস-নুদুস চেহারা। বসারত অবস্থায় গড়ন ডিম্বাকৃতির দেখায়। দেখতে অনেকটাই বাজারে পাওয়া যায়, (খাঁচায় পালিত) কোয়েল পাখির মতো। যত্রতত্র দেখার নজির নেই। মূলত আর্দ্র তৃণভূমি এদের প্রধান বিচরণ ক্ষেত্র। এ ছাড়াও রাস্তার আশপাশের ঘন ঝোপজঙ্গলের ভেতর বিচরণ করে। খাবারের সন্ধানে বের হয় জোড়ায় কিংবা পারিবারিক ছোটদলে। খাবার খোঁজে মুরগির মতো মাটিতে আঁচড় কেটে কিংবা ঝরাপাতা উল্টিয়ে। শিকাররত অবস্থায় ডাকে ‘কুঈ-কী- কিউ’ সুরে। ভয় পেলে সুর পাল্টে যায়, তখন ‘টির..টির..টির..’ সুরে ডাকে। ‘নীলাভবুক বটেরা’ এক সময় ঢাকা ও সিলেট বিভাগের তৃণভূমিতে দেখা যেত। বিশেষ করে সিলেটের চা বাগানের ভেতর পোকামাকড় খুঁজে বেড়াত। হালে দেখা যাওয়ার রেকর্ড নেই। আমরা সে রকম জোরালো তথ্যও আজ অবধি পাইনি। বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, চীন, ফিলিপাইন ও ইন্দোনেশিয়ায় নীলাভবুক বটেরাদের বিস্তৃতি রয়েছে। এ ছাড়াও অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা যায়। প্রজাতিটি বিশ্বে বিপন্মুক্ত, বাংলাদেশে অপ্রতুল তথ্য শ্রেণীতে রয়েছে। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে প্রজাতিটি সংরক্ষিত। পাখির বাংলা নাম: ‘নীলাভবুক বটেরা’, ইংরেজি নাম: ব্লু ব্রেস্টেড কোয়েল’ (Blue-breasted Quail), বৈজ্ঞানিক নাম: Coturnix chinensis | এরা ‘রাজবটেরা’ নামেও পরিচিত। বাংলাদেশে ৩ প্রজাতির বটেরা নজরে পড়ে। যথাক্রমে নীলাভবুক বটেরা, বৃষ্টি বটেরা বা চীনা বটেরা, বড় বটেরা। প্রজাতি লম্বায় ১৪ সেন্টিমিটার। ওজন ৫০ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারা ভিন্ন। পুরুষ পাখির কপাল স্লেট-নীল। মাথায় অস্পষ্ট সাদা-কালো ডোরা। পিঠ বাদামি ছিট এবং লালচে-বাদামির মিশ্রণ। গলায় সাদা-কালো চওড়া দাগ। বুক স্লেট নীল। পেট ও লেজ ঢাকনি লালচে-তামাটে। ঠোঁট খাটো, শিং কালো। পা হলুদ। অপরদিকে স্ত্রী পাখির কপাল লালচে। ঘাড়ের নিচ থেকে ডানা পর্যন্ত ছিট দাগ। বুক ও বগলে কালো ডোরা। অপ্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ পাখির বর্ণ অনুজ্জ্বল। এদের তলপেটে তামাটে রং দেখা যায় না। প্রধান খাবার: শস্যবীজ, পোকামাকড় ইত্যাদি। প্রজনন মৌসুম জুন থেকে আগস্ট। ঝোপজঙ্গলের ভেতর মাটির প্রাকৃতিক গর্তে ঘাস ও লতাপাতা দিয়ে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ৫-৭টি। স্ত্রী পাখি একাই ডিমে তা দেয়। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৮-২০ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 07/11/2014
বড় চোখগেলো | Large Hawk cuckoo | Hierococcyx sparverioides
বড় চোখগেলো | ছবি: ইন্টারনেট বিরল পরিযায়ী পাখি (বাংলাদেশে খুব একটা দেখা যায় না)। শীতে কদাচিৎ সিলেট বিভাগের চিরসবুজ বনে নজরে পড়ে। এদের বৈশ্বিক বিস্তৃতি পূর্ব ভারত, চীন ও ইন্দোনেশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে। মূলত এরা চিরসবুজ বনের বাসিন্দা। পাতার আড়ালে-আবডালে থাকতে পছন্দ করে। বিচরণ করে একাকি। সামাজিক বন্ধন খুব একটা নেই এদের মধ্যে। প্রজনন মৌসুমে খুব ভোরে এবং গোধূলিলগ্নে ডাকাডাকি করে। এ ছাড়াও পূর্ণিমা রাতে মধুর কণ্ঠে ডাকে ‘পিপক পিপকক.. সুরে। সুরে এক ধরনের মাদকতা রয়েছে। বারবার শুনতে ইচ্ছ করে। প্রজাতিটি বিশ্বে বিপন্মুক্ত হলেও বাংলাদেশে এদের অবস্থান মোটেই সন্তোষজনক নয়। পাখির বাংলা নাম: ‘বড় চোখগেলো’, ইংরেজি নাম: ‘লার্জ হাক কুক্কু’ (Large Hawk-cuckoo), বৈজ্ঞানিক নাম: Hierococcyx sparverioides | লম্বায় ৩৮ সেন্টিমিটার। ওজন ১২৫ গ্রাম। মাথার তালু ও ঘাড় ছাই-ধূসর। দেহের উপরাংশ ছাই-বাদামি ডোরা হলেও কিছু জায়গা থেকে লালচে-বাদামির আভা বের হয়। দেহতল সাদাটে। বুক থেকে লেজের তলা পর্যন্ত মোটা বাদামি বলয়যুক্ত। লেজের কালো ও বাদামি বিন্যাস থরে থরে সজ্জিত। লেজের অগ্রভাগ সাদা। চোখ কমলা-হলুদ। পা ও পায়ের পাতা হলুদ। ঠোঁটের উপরের অংশ কালচে শিঙরঙা, নিচের অংশ সবুজাভ-সেøট রঙের। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারায় তেমন কোনো পার্থক্য নেই। তবে অপ্রাপ্তবয়স্কদের রঙে তফাৎ রয়েছে। ওদের ঘাড়ের পেছন দিক ফ্যাকাসে লালচে। বাদামির পরিবর্তে পিঠে লালচে ডোরা। বুকে স্পষ্ট বাদামি ডোরা। প্রধান খাবার: শুঁয়োপোকা, ছারপোকা, ফড়িং, গুবরে পোকা, মাকড়সা ও পিঁপড়া। প্রজনন মৌসুম এপ্রিল থেকে জুন। অঞ্চলভেদে প্রজনন ঋতু ভিন্ন হয়। নিজেরা বাসা বাঁধতে জানে না বিধায় ডিম পাড়ে পেঙ্গা অথবা মাকড়মার পাখির বাসায়। ডিমের সংখ্যা ১-২টি। প্রকৃতি এদেরকে ডিমের আকার ও বর্ণ ভিন্নতর করার ক্ষমতা দিয়েছে। যার ফলে এরা ছোট পাখির বাসাতে যখন ডিম পাড়ে তখন ডিমের আকৃতি ওই পাখিদের ডিমের সমান পাড়তে পারে। আবার বড় পাখিদের বাসায় বসলে বড় সাইজের ডিম পাড়ে। এমনকি ডিমের বর্ণও হুবহু মিলিয়ে ফেলতে পারে। যেমন পেঙ্গার বাসার জন্য ডিমের বর্ণ নীল, মাকড়মারের বাসার জন্য বাদামি ডিম পাড়ে। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 20/06/2014