কালাগলা মানিকজোড় | Black necked Stork | Ephippiorhychus asiaticus
কালাগলা মানিকজোড় | ছবি: ইন্টারনেট বিরল দর্শন পরিযায়ী পাখি। হালে দেখা যাওয়ার নজির নেই। বাংলাদেশে সর্বশেষ দেখা গেছে প্রায় ৬৭ বছর আগে। এদের বিচরণ হাওর-বাঁওড় জলাশয় এলাকায়। হাঁটুজলে নেমে শিকার খোঁজে। এরা দলবদ্ধ হয়ে বিচরণ করে না। সাধারণত এক জোড়ার বেশি কোথাও দেখা যায় না। তবে শিকারে বের হলে শামুকখোল পাখির সঙ্গে দল বাঁধতে দেখা যায়। খাবারে তেমন কোনো বাছবিচার নেই। পচাগলা থেকে শুরু করে সব ধরনের খাবার এদের প্রিয়। রাত যাপন করে গাছের সবচেয়ে উঁচু ডালে। দিনের বেলা জলাশয়ের পাড়ে হাঁটুগেড়ে বিশ্রাম নেয়। বাংলাদেশ ছাড়াও বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া ও লাওস পর্যন্ত। এ ছাড়াও পাপুয়া নিউগিনি এবং অস্ট্রেলিয়ায় সামান্য নজরে পড়ে। পাখিবিশারদদের মতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বড়জোর এক হাজার ‘কালাগলা মানিকজোড়’ রয়েছে। সারা বিশ্বে এদের অবস্থান তত ভালো নয় বিধায় আইইউসিএন এদের লাল তালিকাভুক্ত করেছে। পাখির বাংলা নামঃ কালাগলা মানিকজোড়, ইংরেজী নামঃ ব্লাক নেকেড স্টর্ক (Black necked Stork) বৈজ্ঞানিক নামঃ Ephippiorhychus asiaticus। এরা ‘কালোগলা বক ও লোহারজঙ্গ’ নামেও পরিচিত। প্রজাতির গড় দৈর্ঘ্য ১৫০ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারায় সামন্য পার্থক্য রয়েছে। পাখিবিশারদ ব্যতীত এ পার্থক্য নিরুপণ করা বড়ই কঠিন। সূক্ষ্ম সেই পার্থক্যটা হচ্ছে স্ত্রী পাখির চোখের তারা হলুদ, পুরুষ পাখির চোখের তারা বাদামি-কালো। এ ছাড়া বাদবাকি একই রকম। বলা যায়, এরা সাদা-কালো রঙের পাখি। মাথা ও গলা কালো। পিঠের মাঝখান থেকে লেজের উপরিভাগ পর্যন্ত কালো। দেহের বাকি অংশ সাদা। ঠোঁট কালো। পা ও পায়ের পাতা উজ্জ্বল লাল। অপ্রাপ্ত বয়স্কদের রং ভিন্ন। ওদের মাথা থেকে পিঠের দিক বাদামি। ওড়ার পালক কালচে। পা গাঢ় লাল। প্রধান খাবারঃ ছোট সাপ, ব্যাঙ, ইঁদুর, বাইম মাছ। শিঙ-মাগুর মাছের প্রতিও আসক্তি রয়েছে। প্রজনন মৌসুম সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। বাসা বাঁধে জলাশয়ের কাছাকাছি গাছের উঁচু ডালের তেমাথায়। বাসা মাচা আকৃতির। বাসা বানাতে উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে শুকনো সরু ডালপালা। ডিম পাড়ে তিন-চারটি। ফুটতে সময় লাগে ২৯-৩১ দিন। লেখকঃ আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।
লালমাথা টিয়া | Plum-headed Parakeet | Psittacula cyanocephala
লালমাথা টিয়া | ছবি: ইন্টারনেট স্থানীয় প্রজাতির হলেও বিরল দর্শন। কালেভদ্রে দেখা মেলে মিশ্র চিরসবুজ বনে অথবা শাল বনে। দেখা যেতে পারে গ্রামীণ বনাঞ্চলেও। সামাজিক পাখি। ঝাঁক বেঁধে বিচরণ করে। তবে আমাদের দেশে বড় ঝাঁকে নজরে পড়ে না। গড়ন স্লিম। মনোহরণকারী রূপ। পুরুষের তুলনায় স্ত্রী পাখি কিছুটা নিষ্প্রভ। বাংলাদেশ ছাড়াও বৈশ্বিক বিস্তৃতি শ্রীলঙ্কা, ভারত, নেপাল, পাকিস্তান ও পূর্ব ভুটান পর্যন্ত। স্বভাবে হিংস । প্রজনন মুহূর্তে স্ত্রী পাখির হিংস তা বেড়ে যায় বহুগুণ। এরা ভালো পোষ মানে। শেখালে কথাও বলতে পারে। ক্রীড়ামোদী পাখি। খাঁচায় বন্দি অবস্থায় নানা কসরত দেখায়। খেলা করে এটাসেটা নিয়ে। বল আকৃতির গোলাকার কিছু পেলে ঠোঁট দিয়ে ঠেলতে থাকে। বলা যায় সারাদিন ব্যস্ত সময় পার করে তা নিয়ে। পাখির বাংলা নাম: ‘লালমাথা টিয়া’, ইংরেজি নাম: প্লাম হেডেড প্যারাকিট (Plum-headed Parakeet), বৈজ্ঞানিক নাম: Psittacula cyanocephala| এরা ‘তাল কেশ টিয়া’ নামেও পরিচিত। অনেকে এদেরকে ‘আলুবোখারা-মাথা পাখি’ নামে ডাকে। আবার হিমালয়াঞ্চলে কেউ কেউ এদেরকে ‘পুষ্প কেশ টিয়া’ নামেও ডাকে। দৈর্ঘ্য কমবেশি ৩৬ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারা ভিন্ন। পুরুষ পাখির মাথা গোলাপি রক্ত বর্ণ। ঘাড়ে মালাসদৃশ কালো রেখা। পিঠ হলুদাভ সবুজ। ডানা সবুজ। ডানার গোড়ায় রয়েছে খয়েরি-লাল পট্টি যা স্ত্রী পাখির নেই। নীলাভ-সবুজ লম্বা লেজ। তন্মধ্যে সবচেয়ে লম্বা পালকের প্রান্ত সাদাটে। দেহতল হলুদাভ-সবুজ। উপরের ঠোঁট কমলা-হলুদ, নিচের ঠোঁট কালো। পা সবুজেটে। অপরদিকে স্ত্রী পাখির মাথা ধূসর। ঘাড়ে হলুদাভ বন্ধনী। উপরের ঠোঁট ভুট্টা হলুদ। নিচের ঠোঁট কালচে। প্রধান খাবার: শস্যবীজ, ছোট ফল, ফুলের পাপড়ি। পোষা পাখি বাদাম, দুধভাত, সবজি খায়। প্রজনন মৌসুম এপ্রিল থেকে মে। গাছের প্রাকৃতিক কোটরে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ৪-৬টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৯-২৩ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, , ২৯/০৫/২০১৫
লাল বুক টিয়া | Red Breasted Parakeet | Psittacula alexandri
লাল বুক টিয়া | ছবি: ইন্টারনেট আবাসিক পাখি। মিশ্র চিরসবুজ বনের বাসিন্দা হলেও শালবনে বেশি দেখা যায়। লোকালয়েও দেখা মেলে, তবে কম। স্থানীয় প্রজাতির হলেও সুলভ দর্শন অঞ্চলভেদে। যেমন: সিলেটের চা বাগান, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলে ব্যাপক নজরে পড়ে। বিচরণ করে ছোট-বড় দলে। কৃষকের ধান, গম, ভুট্টাক্ষেতে দল বেঁধে নেমে ব্যাপক ক্ষতি করে, যা খায় তারচেয়ে বেশি নষ্ট করে। দেখতে ভীষণ সুন্দর হলেও কণ্ঠস্বর কর্কশ। সামাজিক পাখি, দলবদ্ধভাবে বাস করে। দলের যে কেউ বিপদের গন্ধ পেলে ‘ক্যাঁক..ক্যাঁক’ স্বরে ডেকে সবাইকে সতর্ক করে। বিপৎসংকেত পেয়ে সঙ্গীরা ঝটপট ডানা মেলে নিরাপদে পৌঁছায়। এত সতর্ক থাকার পরেও এরা শিকারিদের কবলে পড়ছে দেদার- যার ফলে আজ প্রজাতিটি সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে। পাখির বাংলা নাম: ‘লাল বুক টিয়া’, ইংরেজি নাম: ‘রেড ব্রেসটেড প্যারাকিট’ (Red-Breasted Parakeet), বৈজ্ঞানিক: Psittacula alexandri | নাম: ‘সিট্টিসিদি’। এরা ‘তোতা ও মদনা’ নামে পরিচিত। প্রজাতি লম্বায় লেজসহ ৩৪-৩৮ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারা ভিন্ন। পুরুষের মাথা বেগুনি-ধূসর, কপালের ওপর কালো পট্টি, যা চোখের কাছে গিয়ে মিশেছে। ডানায় সোনালি আভা। গলা থেকে বুক পর্যন্ত গোলাপি। পেট নীলচে-সবুজ, তলপেট থেকে লেজের নিচ হলদেটে-সবুজ। লেজের ওপরের দিক নীলচে-সবুজ। লেজের ডগার কিনারটা হলদেটে। শক্ত মজবুত ঠোঁট বড়শির মতো বাঁকানো। ঠোঁটের বর্ণ ওপরের দিকে রক্ত লাল, নিচের অংশ কালো। স্ত্রী পাখির মাথা নীলচে-সবুজ। বুকের দিক গাঢ় গোলাপি। ঠোঁটের ওপরাংশ কালো, নিচের অংশ পাটকিলে-কালো। এ ছাড়াও পুরুষ পাখির কনীনিকা ফিকে-হলুদ, স্ত্রী পাখির সাদাটে-হলুদ। উভয়ের পা ও আঙ্গুল ধূসরাভ-সবুজের সঙ্গে হলটে মিশ্রণ । প্রধান খাবার: শস্যবীজ, ফুল, ফল, মধু, গাছের কচিপাতা ইত্যাদি। পোষা তোতাদের দুধ-ভাত, কলা, বাদামের প্রতি আসক্তি রয়েছে। প্রজনন সময় জানুয়ারি থেকে এপ্রিল। গাছের প্রাকৃতিক কোটরে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ২-৪টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২২-২৪ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।প্রকাশ: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 11/06/2017 এবং দৈনিক যুগান্তর, 31/08/2013
বড় বনলাটোরা | Large Woodshrike | Tephrodornis gularis
বড় বনলাটোরা | ছবি: ইন্টারনেট মিশ্র পর্ণমোচী বন, বন প্রান্তর এবং চিরহরিৎ বনের বাসিন্দা। স্থানীয় প্রজাতির পাখি। বাংলাদেশ ছাড়া বড় বনলাটোরার বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত, নেপাল, মিয়ানমার, চীন, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর পর্যন্ত। দূরদর্শনে ‘পাতি বনলাটোরা’ মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। চেহারায়ও খুব একটা ভিন্নতা নেই। শুধু আকারে একটু বড় এরা। প্রজাতির কারোই আহামরি রূপ নেই। তবে চেহারাটা মায়াবি ধাঁচের। বিশেষ করে ওদের কাজল কালো চোখ পাখি প্রেমীদের মায়া জাগিয়ে তোলে। প্রজাতির দেখা মেলে শুষ্ক বন-বনানী কিংবা ঘন পাতার গাছগাছালির ডালে। ভাওয়াল শালবনে বেশি দেখা মেলে। স্বভাবে শান্ত। কিছুটা লাজুকও। উঁচু গাছের ঘন পাতার আড়ালে বিচরণ করে। শিকারে বের হয় জোড়ায় কিংবা ছোট দলে। পতঙ্গভুক অন্যান্য পাখির সঙ্গেও শিকারে বের হয়। মাটিতে নেমেও শিকার খোঁজে। প্রজনন মৌসুমে পুরুষ পাখি সুর করে গান গায়। সুর শুনতে মন্দ নয়। উভয় প্রজাতিই কিছুটা বোকা কিছিমের। স্ত্রী পাখি যখন ডিমে তা দেয় ঠিক তখনই পুরুষ পাখি মনের আনন্দে সামান্য দূরের গাছের ডালে বসে গান গাইতে থাকে। ফলে চতুর শিকারি পাখিরা বুঝে যায় ওদের বাসার অবস্থান। এবার অন্য প্রসঙ্গে যাচ্ছি। একটি ভালো খবর দিতে চাই আপনাদের। পত্রিকায় প্রকাশিত পাখি নিয়ে আমার লেখাগুলো যারা এক সঙ্গে পেতে চান তারা https://pakhi.tottho.com ঠিকানায় ক্লিক করতে পারেন। এমন একটি সুন্দর ব্যবস্থা করেছেন বগুড়া জেলার একজন প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ হাবিবুর রহমান। ধন্যবাদ জানাচ্ছি তাকে, পাখি সংক্রান্ত সব ক’টি লেখা একত্রিত করার জন্য। এ পাখির বাংলা নাম: ‘বড় বনলাটোরা’, ইংরেজি নাম: ‘লার্জ উডশ্রাইক’ (Large Woodshrike), বৈজ্ঞানিক নাম: Tephrodornis gularis| এরা ‘বড় সুধুকা’ নামেও পরিচিত। দৈর্ঘ্য ১৮-২৩ সেন্টিমিটার। ওজন ২৮-৪৬ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম। উভয়েরই কাজল কালো চোখ। চোখের দু’প্রান্তে চওয়া কালো টান। মাথা নীল কালো। ঘাড় ও পিঠ কালচে-ছাই রঙের। ডানার প্রান্ত কালচে-বাদামি। লেজ গাঢ় খয়েরি। লেজের মধ্যখানের পালক দুটোতে ছাই রঙের ছোপ, বাইরের পালক ময়লা সাদা। গলার নিচে থেকে বুক পর্যন্ত ছাই রঙ। বুকের নিচ থেকে লেজের তলা পর্যন্ত সাদাটে। ঠোঁট সে্লট কালো। পা সিসে-কালো। প্রধান খাবার: কীটপতঙ্গ। বিশেষ করে পঙ্গপাল, ফড়িং ও ঝিঁঝিঁ পোকার প্রতি আসক্তি বেশি। প্রজনন মৌসুম মার্চ থেকে মে। অঞ্চলভেদে প্রজনন সময়ের হেরফের লক্ষ্য করা যায়। বাসা বাঁধে গাছের উঁচুতে তে-ডালের ফাঁকে। ঘাস, লতাপাতা, শিকড় ও মাকড়সার জাল দিয়ে পেয়ালা আকৃতির বাসা বানায়। ডিম পাড়ে ২-৩টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১২-১৫ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 20/11/2015
গগনবেড় | Great white pelican | Pelecanus onocrotalus
গগনবেড় | ছবি: ইন্টারনেট দেশে খুব কমই দেখা মেলে এ পাখির। বলা যায় অতিবিরল প্রজাতির বৃহৎ জলচর পাখি এরা। সুন্দরবনসহ দেশের বিভিন্ন নদনদীতে তিনযুগ আগেও দেখা যেত। হালে খুব একটা দেখা যায় না। নব্বই দশকের শেষাবধি ঢাকা চিড়িয়াখানার লেকে মাত্র ৩টি পাখির দেখা মিলেছে। ওখানে মাসখানেক কাটিয়েছে ওরা। বিদায় হয়ে আর ঢাকামুখী হয়নি পাখিগুলো। অতঃপর দেখা গেছে ২০০০ সালের দিকে দিনাজপুরের কাহারোল বিলে। সেখানে সংখ্যায় ছিল মাত্র একটি। স্থানীয় লোকজন পাখিটিকে ধরে রামসাগর দীঘির অভয়ারণ্যে নিরাপদে রাখলেও কিছুদিন পর সেটি মারা যায়। এতদাঞ্চলে এ প্রজাতির পাখির সাক্ষাৎ পাওয়ার আর রেকর্ড নেই। বছর আটেক আগে পরিচিত একজন পর্যটক জানিয়েছেন, তিনি নাকি দুটি পাখি সুন্দরবনের শাখা নদীতে বিচরণরত দেখেছেন। ওদের সন্ধানে সেখানে গেলে নিরাশ হয়ে ফিরে আসি আমরা। উল্লেখ্য, ইতিপূর্বে ১৯৯৬ সালের জানুয়ারিতে সুন্দরবন গিয়ে ব্যাপক তল্লাশি চালিয়েও আমরা সফল হয়নি। তবে এদের সাক্ষাৎ আমি সুন্দরবনে না পেলেও পেয়েছি ঢাকা চিড়িয়াখানার লেকেই। পাখিগুলো দেখে সেদিন ভীষণ মুগ্ধ হয়েছি। দেখতে ভারি সুন্দর, আকারেও বৃহৎ। শরীরের মাংসের আধিক্যের কারণে বেঁচে থাকতে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মূলত মাংসের লোভেই শিকারিরা এদের শিকার করে অস্তিত্বের সংকটে ফেলে দিয়েছে। এ ছাড়া জলাশয় সংকটের কারণেও এরা আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। সুুন্দর এ পাখিদের বাংলা নামঃ গগনবেড় , ইংরেজি নামঃ গ্রেট হোয়াইট পেলিক্যান (Great white pelican), বৈজ্ঞানিক নামঃ Pelecanus onocrotalus। গগনবেড় লম্বায় প্রায় ১৮৩ সেন্টিমিটার। গায়ের বর্ণ দুধ সাদা হলেও ডানার ওপরে রয়েছে গোলাপি আভা। বুক ও পেটের দিকে হলদেটে। ওড়ার পালক কালো। ঠোঁট বেশ বড়। ঠোঁটের নিচে রয়েছে চামড়ার থলে। থলের রঙ কমলা-হলুদ। ওপরের ঠোঁটের মধ্যে রয়েছে লম্বা প্লেট। নিচের ঠোঁটের কিনারা ধূসর। চোখের চারপাশে পালকহীন চামড়া। পা ও পায়ের পাতা গোলাপি। কপালে রয়েছে সাদা পালক, যা ওপরের ঠোঁটের গোড়ায় মিলিত হয়েছে। মাথায় রয়েছে সাদা ঝুঁটি। প্রজনন সময় কেটে গেলে গলার নিচের থলের বর্ণ বদলে হলুদাভ বা কমলা রঙ ধারণ করে। ওই সময় মাথার ঝুঁটির পালক ও গায়ে হলুদের আভা থাকে না। অপ্রাপ্ত বয়স্ক পাখিদের ডানায় কালো এবং বাদামির পরিমাণ বেশি থাকে, আর ঠোঁট থাকে কালচে হলুদ। প্রধান খাদ্যঃ মাছ। এদের মাছ শিকারের কৌশল বেশ মজাদার। এরা দলবদ্ধ হয়ে ঠোঁট ফাঁক করে মাছদের তাড়া করে নিজেদের থলেতে ঢুকিয়ে ঝাঁকুনি দিয়ে গিলে ফেলে। প্রজনন সময় এপ্রিল থেকে মে। বড় গাছে দলবদ্ধভাবে বাসা বাঁধে। বাসা বানাতে উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে চিকন ডালপালা। বাসার শ্রীরিছাদ নেই। অগোছালো। চিল বা বাজপাখির বাসার মতো। ডিম পাড়ে ৩-৪টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৯-৩৬ দিন। শাবক স্বাবলম্বী হতে সময় নেয় ৬৫-৭৫ দিন। পূর্ণ যৌবনপ্রাপ্ত হতে সময় লাগে ৩-৪ বছর। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।
দেশি কানিবক | Indian Pond Heron | Ardeola grayii
দেশি কানিবক | ছবি: ইন্টারনেট স্থানীয় বাসিন্দা। সুলভ দর্শন। এ প্রজাতির পাখি মানুষের কাছে অতি পরিচিত। দেশে বেশ ভালো অবস্থানেও রয়েছে এরা। গ্রামাঞ্চলের জলাশয়গুলোতে এদের রয়েছে ব্যাপক বিচরণ। জলাশয়ের কিনারে বা ঝোঁপের ভেতর ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে থাকে। কোনো রকম শিকারের অনাগোনা নজরে পড়লেই ওদের তীক্ষ চঞ্চুটা তরবারির মতো চালিয়ে দেয়। শিকার দর্শন না পেলেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধ্যানমগ্নের ন্যায় কাটিয়ে দেয়। এরা বেশির ভাগই একাকী শিকারে বের হয়। আবার কখনো কখনো দলবদ্ধ হয়েও শিকারে বের হয়। তবে যে যেখানেই থাকুক না কেন, রাত কাটায় দলবদ্ধভাবেই। বিশেষ করে বাঁশগাছে রাত্রিযাপন করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। বাসাও বাঁধে বেশিরভাগ বাঁশগাছেই। দর্শন সহজলভ্য বিধায় এরা শিকারিদের খপ্পরে পড়ে বেশি। গুলি ছাড়াও ফাঁদ পেতে দেশি কানিবক শিকার করে গ্রামের দুষ্ট ছেলেরা। পাখিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি এরা শিকারির কবলে পড়ে। এ পাখির বাংলা নাম: ‘দেশি কানিবক’, ইংরেজি নাম: ‘ইন্ডিয়ান পন্ড হেরন’ (Indian Pond Heron), বৈজ্ঞানিক নাম: (Ardeola grayii)। এরা কোঁচবক, কানিবক বা কানাবক নামেও পরিচিত। এরা লম্বায় ৪৬ সেন্টিমিটার। মাথা, গলা ও বুক বাদামি-সাদা ডোরার মিশ্রণ। পিঠ ধূসর বাদামি। বুকের নিচ থেকে লেজ পর্যন্ত সাদা। চোখের তারা হলুদ। ঠোঁট লম্বা তীক্ষè। ঠোঁটের গোড়া হলদেটে, অগ্রভাগ কালচে। পা হলুদ। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। প্রধান খাবার: মাছ, এছাড়াও ছোট ব্যাঙ, জলজ পোকামাকড় শিকার করে। প্রজনন সময় মধ্য জুন থেকে আগস্ট। বড় গাছের ডালে অথবা বাঁশগাছে কলোনি টাইপ বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ৩-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৮-২৪ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 22/11/2013
ভেকঠোঁটি রাতচরা | Hodgson’s Frogmouth | Batrachostomus hodgsoni
ভেকঠোঁটি রাতচরা | ছবি: ইন্টারনেট স্থানীয় প্রজাতির হলেও বিরল দর্শন ‘ভেকঠোঁটি রাতচরা’। বিচরণ করে সমুদ্র পৃষ্ট থেকে ৩০০-১৯০০ মিটার উচ্চতার পাহাড় কিংবা ক্রান্তীয় চিরহরিৎ বনে। এ ছাড়া মিশ্র চিরসবুজ বনে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশে খুব একটা দেখার নজির নেই। আমাদের পূর্বসূরি পাখি বিশারদের তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, এক সময় মধুপুর বনে এদের বিচরণ ছিল। তবে খুব বেশি দেখার তথ্য নেই। প্রজাতিটি দেখতে কুৎসিত, ভয়ঙ্কর চেহারার। মূলত এদের মুখের গঠন অনেকটাই ব্যাঙ আকৃতির। নামকরণেও সে রকমটি ইঙ্গিত পাওয়া যায়। প্রজাতির দেহের বর্ণের সঙ্গে গাছের মরা ডালপালা কিংবা শুকনো লতা-পাতার যথেষ্ট মিল রয়েছে। যার ফলে দিনের বেলায় প্রাকৃতিক পরিবেশে লুকিয়ে থাকলেও খুঁজে বের করা মুশকিল। এরা নিশাচর পাখি। দিনের বেলায় ঘুমিয়ে কাটায়। রাতের আঁধার নেমে এলে কেবল শিকারে বের হয়। বেশির ভাগ একাকী শিকারে বের হয়। উড়ন্ত পোকামাকড় দেখলে ছোঁ মেরে মুখে পুরে ফেলে। প্রিয় পাঠক, ‘রাতচরা’ বা ‘নাইটজার’ প্রজাতির পাখির চেহারায় তত আকর্ষণ নেই। অনেকে এদের পেঁচা বলে ভুল করে থাকেন। আসলে এরা পেঁচাদের স্বজন নয়। আমাদের দেশে মোট পাঁচ প্রজাতির রাতচরা পাখি দেখা গেলেও ব্যাঙমুখো প্রজাতির পাখি শুধু এরাই। পর্যায়ক্রমে আমরা রাতচরা প্রজাতির অন্যদের নিয়েও লেখার চেষ্টা করব। প্রজাতিটি বিশ্বে বিপদমুক্ত হলেও বাংলাদেশে বিরল দর্শন হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। পাখির বাংলা নাম: ‘ভেকঠোঁটি রাতচরা’, ইংরেজি নাম: ‘হজসন’স ফ্রগমাউথ’(Hodgson’s Frogmouth), বৈজ্ঞানিক নাম: Batrachostomus hodgsoni | এরা ‘হজসনি ব্যাঙমুখো’ নামেও পরিচিত। লম্বায় ২৬-২৮ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখির মধ্যে সামান্য পার্থক্য রয়েছে। পুরুষ পাখির ঘাড় এবং গলায় সাদা ফোঁটা। পিঠ ধূসরাভ-বাদামি। পেটের দিকে এলোমেলো সাদা। লেজের ওপর ধূসর বলয়। অন্যদিকে স্ত্রী পাখির ঘাড়ে সাদা ফোঁটা। পিঠ গাঢ় লালচে-বাদামি। পেটে অসংখ্য সাদা ফোঁটা। দেহের অন্যত্র দাগ বা ফোঁটা নেই। উভয়ের ডানা খাটো, লেজ লম্বা এবং মুখ-মাথায় সামান্য লোম দেখা যায়। চোখ বাদামি। ঠোঁট বাদামি-কালচে। প্রধান খাবার: উড়ন্ত পতঙ্গ বা পোকামাকড়। প্রজনন মৌসুম এপ্রিল থেকে জুলাই। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের দেখা যায়। বাসা বাঁধে গাছের ডালে। ডিম পাড়ে ১-৩টি। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 27/03/2015