সাতভায়লা পাখি | Jungle babbler | Turdoides striata
সাতভায়লা পাখি | ছবি: ইন্টারনেট কথিত আছে, এক গেরস্থের সাত ছেলে ছিল। ছেলেদের বিয়ের উপযোগী বয়স হলে বাবা পাত্রীর সন্ধানে ঘটক লাগালেন। ঘটক পাশের গ্রামে বাসরত সুন্দরী এক পাত্রীর সন্ধান দিলেন। কনে দেখে সাত ভাইয়েরই পছন্দ হয়ে গেল। সাতভাই প্রত্যেকেই চায় ওই পাত্রীকে বউ করে ঘরে নিতে। এ নিয়ে ওদের মাঝে বিবাদও বাধে। বিষয়টা নিয়ে হট্টগোল সৃষ্টি হলে এবং তা চাউর হতেই ওই গ্রাম থেকে পালিয়ে যায় পাত্রী। পাত্রী নিখোঁজ হওয়ার সংবাদটা সাতভাইয়ের কানে গেলে পাগলের মতো হয়ে যায় তারা। ওরা সবাই মিলে পাত্রীকে খুঁজতে থাকে আশপাশের সব গ্রামে। খুঁজতে খুঁজতে এক সময় হয়রান হয়ে ওরা ওপরওয়ালার কাছে আবেদন জানায় পাখি বানিয়ে দিতে। যাতে উড়ে উড়ে তল্লাশি চালাতে পারে। সৃষ্টিকর্তা সাতভাইয়ের ফরিয়াদ কবুল করে ওদের পাখি বানিয়ে দেন। সেই থেকে ওরা পাখি হয়ে গ্রামগঞ্জের আনাচে-কানাচে বিচরণ করছে আজঅবধি। হাল আমলে এরা কাউকে না খুঁজলেও ওদের চলাফেরা দেখে এখনো সে রকমটিই মনে হয়। বিচরণের সময় এরা হঠাৎ প্রচণ্ড ঝগড়ায় মেতে ওঠে আবার নিমেষেই মিলেও যায়। এমন স্বভাবটি নাকি ওরা মানুষ থাকায় অবস্থায়ও ছিল। উল্লেখ্য, এরা দলে শুধু সাতটিই নয় ১০-১৫টিও একত্রে থাকে। এ পাখির বড় গুণটি হচ্ছে এদের দলের কেউ বিপদে পড়লে এগিয়ে যায়। এ ছাড়া চমৎকার তথ্যটি হচ্ছে, এ পাখিদের মধ্যে কোনো জুড়ি যদি ডিম পাড়ে তাহলে অন্যরা গিয়েও সে ডিমে তা দেয়। শুধু তাই-ই নয় ডিম থেকে বাচ্চা ফুটলে সবাই মিলে ওদের খাইয়ে দেয় পর্যন্ত। এরা ডাকে ‘কিচ্-কিচ্ বা কিক-কিক’ সুরে। ভালো উড়তে পারে না। মাটিতে হাঁটে লাফিয়ে লাফিয়ে। কোকিল গোত্রীয় দুই-এক প্রজাতির পাখিরা এদের বাসায় ডিম পাড়ে। এ পাখির বাংলা নাম: ‘সাতভায়লা’, ইংরেজি নাম: ‘জাঙ্গল ব্যাবলার’ (Jungle babbler), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘টার্ডিডেস স্ট্রায়াটাস’(Turdoides striata) | গোত্রের নাম: ‘সিলভিআইদি’। সাতভাই নামেও এরা পরিচিত। লম্বায় এরা ২৩-২৫ সেন্টিমিটার। গায়ের সমস্ত পালক মেটে বর্ণের। শরীরে কোনো রেখা নেই। তবে ওপরে নিচের অধিকাংশ পালকের মাঝ-দণ্ড ফ্যাকাসে বিধায় পালক দ্বি-রঙবিশিষ্ট মনে হয়। এদের চোখের বলয় সাদা। ঠোঁট মজবুত ও মোটা। বর্ণ হলুদ। পায়ের বর্ণও তদ্রƒপ হলদেটে। শরীরে তুলনায় লেজ খানিকটা লম্বা। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। সাতভায়লা পাখির প্রিয় খাবার ফুলের মধু ও খেজুরের রস। স্বাভাবিক খাবার কীটপতঙ্গ, কেঁচো, ছোট ব্যাঙ ইত্যাদি। প্রজনন সময় মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর। বাসা বাঁধে ঝোপজঙ্গলের ভেতর ছোট গাছের ডালে। বাসা বানাতে উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে ঘাস-লতা। বাসাটা দেখতে পেয়ালার মতো। ডিমের সংখ্যা ৩-৪টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৪-১৬ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 29/09/2013
বাজপাখি | Common Buzzard | Buteo buteo
বাজপাখি | ছবি: ইন্টারনেট শীতে পরিযায়ী হয়ে আসে। নজরে পড়ে খোলা মাঠ-বিল প্রান্তরে। খরগোশ, সাপ, গলিত মাংস, কীটপতঙ্গ এসব শিকার করে। পারতপক্ষে জলাশয় থেকে মাছ শিকার করে না। চাষাবাদ হয় এমন ক্ষেত-খামারের কাছাকাছি বেশি নজরে পড়ে। ফসলের ক্ষেত্রেও বিচরণ রয়েছে। বিচরণ করে জোড়ায় কিংবা ছোট দলে। অনেক ক্ষেত্রে ১০-১৫টির দলেও দেখা যায়। আকাশের অনেক উঁচুতে উঠে অনেকখানি পরিধি নিয়ে ঘুরতে থাকে। দীর্ঘক্ষণ শূন্যে ভেসে থাকতে পছন্দ করে। এরা শিকারি পাখি হলেও স্বভাবে তেমন হিংস নয়। প্রজাতির চারাভিযান বাংলাদেশ, ভারত, ইউরোপ, রাশিয়া, আফ্রিকা, তুরস্ক, জাপান, থাইল্যান্ড, হংকং এবং দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল। বিশ্বে এরা ভালো অবস্থানে নেই। >পাখির বাংলা নাম: ‘বাজপাখি’, ইংরেজি নাম: ‘কমন বাজার্ড’ (Common Buzzard), বৈজ্ঞানিক নাম: Buteo buteo | এরা ‘পাতি তিসাবাজ’ নামেও পরিচিত। প্রজাতি দৈর্ঘ্যে ৪০-৫৮ সেন্টিমিটার। গড় ওজন ৪২৭ গ্রাম। প্রসারিত পাখা ১০৯-১৩৬ সেন্টিমিটার। স্ত্রী পাখি সামান্য বড়। মাথা, ঘাড়, পিঠ, ডানা ও লেজ কালচে বাদামির সঙ্গে সাদা ছোপ। ঘাড়ে, গলায় সাদা ছোপ স্পষ্ট। বুক, পেট ও বস্তি প্রদেশ হলদে বাদামির ওপর হলদে সাদা ছিট। চোখের বলয় হলুদ। কালো মণির চারপাশ বাদামি। বড়শির মতো বাঁকানো ঠোঁট কালো, গোড়া হলুদ রঙের। মুখের কিনারটাও হলুদ। পা হলুদ ও নখ কালো। প্রধান খাবার: খরগোশ, ছোট সাপ, ইঁদুর, টিকটিকি, ব্যাঙ, কাঁকড়া, পোকামাকড় ইত্যাদি। প্রজনন মৌসুম মধ্য এপ্রিল। গাছের উঁচু শিখরে সরু ডালপালা দিয়ে অগোছালো বাসা বাঁধে। মাটিতে বা পাথুরে এলাকায়ও বাসা বাঁধে। একই বাসা বারবার ব্যবহার করে। ডিমের সংখ্যা ২-৪টি। তিন দিন অন্তর ডিম পাড়ে। ডিম ফুটতে সময় লাগে ৩৩-৩৫ দিন। শাবক স্বাবলম্বী হতে সময় লাগে ৬-৮ সপ্তাহ। তিন বছর বয়সে বয়োপ্রাপ্ত হয়। গড় আয়ু ২৫ বছর। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 05/05/2017
সাদাটে মেঠো চিল | Pallid Harrier | Circus macrourus
সাদাটে মেঠো চিল | ছবি: ইন্টারনেট বিরল প্রজাতির ভবঘুরে পাখি। লম্বা পা, হলুদ গোলাকার চোখ ওদেরকে রাগী চেহারায় রূপ দিয়েছে। মূলত এরা হিংস্র নয়। বরং প্রজাতির অন্যদের তুলনায় দেখতে খানিকটা সুদর্শন। দেশে শীত মৌসুমে দেখা মেলে। উপমহাদেশীয় অঞ্চলে এরা মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত বিচরণ করে। বাংলাদেশ ছাড়া বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল। এছাড়াও মধ্য এশিয়া, পশ্চিম ইউরোপে এবং পূর্ব আফ্রিকায়ও দেখা মেলে। দেখা মেলে ফিনল্যান্ডেও। এদের বিচরণ ক্ষেত্র ধানক্ষেত, গমক্ষেত, উচুঁ বনভূমি, ছোট নদ-নদী, জলাশয়ের আশপাশ এবং মালভূমির ওপর পর্যন্ত। এরা ক্ষেত খামারের ওপর চক্কর দিয়ে শিকার খোঁজে। বিশ্বে এদের অবস্থান সন্তোষজনক নয়। মূলত শস্যক্ষেতে ব্যাপক কীটনাশক ব্যবহারের কারণে প্রজাতিটি হুমকির মুখে পড়েছে এবং প্রজননে বিঘœ ঘটছে। ফলে আইইউসিএন এদের ইতিমধ্যে লাল তালিকাভুক্ত করেছে। পাখির বাংলা নাম: ‘সাদাটে মেঠো চিল’, ইংরেজি নাম: ‘প্যালিড হ্যারিয়ার’ (Pallid Harrier), বৈজ্ঞানিক নাম: Circus macrourus| এরা ‘ধলা কাপাসি’ নামেও পরিচিত। প্রজাতিটি দৈর্ঘ্যে ৪০-৪৮ সেন্টিমিটার। প্রসারিত ডানা ৯৫-১২০ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখির মধ্যে খানিকটা তফাত রয়েছে। পুরুষের তুলনায় স্ত্রী পাখি আকারে বড় এবং গায়ের রংও ভিন্ন। পুরুষ পাখির গড় ওজন ৩১৫ গ্রাম, স্ত্রী পাখির গড় ওজন ৪৪৫ গ্রাম। পুরুষ পাখির মাথা সাদাটে ধূসর। পিঠ ধূসর। লেজের গোড়া ও অগ্রভাগ বাদামি-কালো। গাঢ় কালো রঙের ঠোঁটের অগ্রভাগ বড়শির মতো বাঁকানো। ঠোঁটের গোড়া হলুদ। চোখ উজ্জ্বল হলুদ, মণি কালো। পা ও পায়ের পাতা হলুদ, নখ কালো। অপরদিকে স্ত্রী পাখির গায়ের পালক মরিচা-বাদামি। দেহতল হালকা বাদামি সাদা। প্রধান খাবার: ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী, পাখি, ইঁদুর, বড় পোকামাকড়, ফড়িং ও পঙ্গপাল। প্রজনন সময় মে থেকে জুন। প্রজনন পরিসীমা দক্ষিণ রাশিয়া, ইউক্রেন, উত্তর-পশ্চিম চীন ও পশ্চিম মঙ্গোলিয়া পর্যন্ত। বাসা বাঁধে ঝোপের ভেতর, জলাভূমির কাছে মাটিতে অথবা ঘেসো ভূমিতে লম্বা ঘাস বিছিয়ে। ডিম পাড়ে ৪-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৮-৩০ দিন। শাবক ৩৫-৪৫ দিনের মধ্যে উড়তে শিখে। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 01/07/2016
সাদা হাঁস | Smew | Mergellus albellus
সাদা হাঁস | ছবি: ইন্টারনেট বাংলাদেশে অনিয়মিত পরিযায়ী পাখি। বলা যায় বিরলতম প্রজাতি। দেশে খুব একটা দেখা যায় না। সর্বপ্রথম ২০০৩ সালে প্রজাতিটি বাংলাদেশে দেখা যাওয়ার তথ্য পাওয়া যায়। মূলত রাশিয়া ও তৎসংলগ্ন তুন্দ্রা অঞ্চলের বাসিন্দা ‘সাদা হাঁস’। এ ছাড়াও ভারত, নেপাল, পাকিস্তান, চীন ও জাপানে বৈশ্বিক বিস্তৃতি লক্ষ্য করা যায়। সমগ্র বিশ্বে ১৯ লাখ বর্গ কিলোমিটারব্যাপী এদের বিস্তৃতি থাকলেও প্রজাতির সংখ্যা তেমন সন্তোষজনক নয়। যার ফলে আইইউসিএন প্রজাতিটিকে ন্যূনতম বিপদযুক্ত বলে ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে প্রজাতিটি সংরক্ষিত। প্রজাতিটি অন্য সব জলচর পাখিদের মতোই জলাশয়ে বিচরণ করে। তবে বড় ধরনের জলাভূমি এদের বেশি পছন্দ। বিচরণ করে ছোট দলে। দিবাচর পাখি এরা। খাবার খোঁজে ডুবিয়ে ডুবিয়ে। ডুবিয়ে জলের তলা স্পর্শ করে শিকার ধরে। উড়তে পারে দ্রুত। প্রায় শব্দহীনভাবে ওড়ে। প্রজননকালীন সময়ে পুরুষ পাখি উড়তে পারে না। এ সময় ওদের নতুন পালক গজায়। হাঁকডাক খুব একটা দেয় না। মাঝেমধ্যে ব্যাঙের মতো নিচু স্বরে শিস কাটে। স্বভাবে শান্ত। পাখির বাংলা নাম: ‘সাদা হাঁস’, ইংরেজি নাম: ‘স্মিউ’ (Smew), বৈজ্ঞানিক নাম: Mergellus albellus| লম্বায় ৩৮-৪৬ সেন্টিমিটার। ওজন প্রায় ৬৮০ গ্রাম। বর্গাকার মাথায় সাদা ঝুলানো ঝুঁটি। ঘাড় কালো। ডানা ও বুকের পাশটা কালচে। এ ছাড়া সমস্ত দেহ ধবধবে সাদা। ঠোঁট আকারে খাটো, অগ্রভাগ বড়শির মতো বাঁকানো। উভয়ের লেজ চুঁচালো। প্রজনন মৌসুমে স্ত্রী-পুরুষ পাখির তফাৎ লক্ষ্য করা যায়। এ সময় পুরুষ পাখির ঠোঁটের গোড়া ও চোখের পাশ কালো রঙ ধারণ করে। বুকের পাশ এবং লেজ ধূসর দেখায়। চোখ লালচে এবং পা ও পায়ের পাতা ফ্যাকাসে দেখায়। স্ত্রী পাখির মাথায় লালচে-বাদামি টুপি এবং ঘাড় ও ঝুঁটি ধূসর বাদামি দেখায়। পা ও পায়ের পাতা সবুজ। প্রজননের বাইরে স্ত্রী-পুরুষের মধ্যে তেমন পার্থক্য নেই। প্রধান খাবার: ছোট চিংড়ি, শামুক, কেঁচো, ব্যাঙ ও জলজকীট। মাছ তেমন একটা খায় না। তবে শীত ও বসন্তের শুরুতে মাছ শিকার করে। প্রজনন সময় এপ্রিল-মে। সাইবেরিয়া অঞ্চলের গাছের প্রাকৃতিক কোটরে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ৭-৯টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৬-২৮ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 16/05/2014
ভুবন চিল | Black Kite | Milvus migrans
ভুবন চিল | ছবি: ইন্টারনেট ভুবন চিল মাঝারি আকারের শিকারি পাখি। দেশের স্থায়ী বাসিন্দা। মূলত এরা নাতিশীতোষ্ণ এবং গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের বাসিন্দা। বৈশ্বিক বিস্তৃতি এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত। দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে কমবেশি নজরে পড়ে। দেশে এদের অবস্থান সন্তোষজনক। জলাশয় কিংবা নদ-নদীর কিনারে এদের সাক্ষাৎ মেলে। একাকী অথবা ছোট দলেও নজরে পড়ে। প্রজাতির অন্যদের মতো অত হিংস নয় ভুবন চিল। সমুদ্রপৃষ্ট থেকে ১৫০০ মিটার উঁচুতেও এদের দেখা যায়। উপরে উঠে বাঁশির মতো সুরে ‘চি..চি..চি..’ আওয়াজ করে। দীর্ঘ সময় ঘুড়ির মতো আকাশে ভেসে থাকতে পারে বিধায় ইংরেজিতে এদেরকে ‘ব্ল্যাক কাইট’ নামে ডাকা হয়। উল্লেখ্য, দূর থেকে এদের গায়ের রং কালো মনে হলেও আসলে এরা বাদামি-কালো মিশ্রণের। পাখির বাংলা নাম: ‘ভুবন চিল’, ইংরেজি নাম: ‘ব্ল্যাক কাইট’ (Black Kite), বৈজ্ঞানিক নাম: Milvus migrans | এরা দৈর্ঘ্যে ৪৭-৫৫ সেন্টিমিটার। গড় ওজন ৪৫০ গ্রাম। মাথা ও ঘাড় বাদামি। পিঠ বাদামি-কালো। গাঢ় বাদামি লেজের প্রান্তরটা কাঁটাযুক্ত মনে হতে পারে। বুক ও পেটে ফ্যাকাসে বাদামি টান। ওড়ার পালক কালো। কালো রঙের ঠোঁট শক্ত মজবুত, অগ্রভাগ বড়শির মতো বাঁকানো। নাকের কিনারটা হলুদ। চোখ গাঢ় বাদামি। পা বাদামি পালকে আবৃত। পা ও পায়ের পাতা হলুদ। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম হলেও স্ত্রী পাখি আকারে সামান্য বড়। অপ্রাপ্ত বয়স্কদের রং ভিন্ন। প্রধান খাবার: টিকটিকি, ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী, পোকামাকড় ও ফড়িং। এ ছাড়াও যাবতীয় ময়লা আবর্জনাও এরা খায়। উপমহাদেশীয় অঞ্চলে প্রজনন সময় জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি। কিছু কিছু স্থানে আগস্ট ও নভেম্বরে বংশ বৃদ্ধি ঘটায়। এ ছাড়াও বছরের যে কোনো সময় বংশ বৃদ্ধি ঘটাতে পারে। স্থানভেদে প্রজনন ঋতুর হেরফের লক্ষ্য করা যায়। বাসা বাঁধে বড় গাছের উঁচু ডালে। চিকন ডালপালা দিয়ে বড়সড় অগোছালো বাসা বানায়। এক বাসায় বহু বছর যাবৎ ডিম বাচ্চা তোলে। ডিম পাড়ে ২-৩টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ৩০-৩৪ দিন। শাবক স্বাবলম্বী হতে সময় লাগে ৫০ দিনের মতো। প্রজননক্ষম হতে সময় লাগে ৪-৫ বছর। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 24/06/2016
লক্ষ্মীপেঁচা | Barn Owl | Tyto alba
লক্ষ্মীপেঁচা | ছবি: ইন্টারনেট এ পাখিদের মুখাবয়ব অনেকটাই মানবশিশুর মতো। গোলাকৃতির মুখ, বড় বড় চোখ এবং চেপ্টা ঠোঁটটি মানুষের নাকের আদলে হওয়ায় এমনটি মনে হয়। একটা সময় এ পাখি আমাদের দেশে সুলভ দর্শন ছিল। বর্তমানে এদের বাসস্থান সংকটের কারণে অসুলভ হয়ে পড়েছে। তাছাড়া এরা কালেভদ্রে নজরে পড়লেও উৎসুক মানুষের কাছে নাজেহাল হয় খানিকটা। অবশ্য যারা এদের চেনেন, তারা মোটামুটি পাখিটাকে নিরাপদে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। এরাও মানুষকে কিছুটা নিরাপদ মনে করে। তাই মানুষের কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করে এ পাখি। গভীর জঙ্গল এদের অপছন্দ। পুরনো দোর-দালান কিংবা গাছের কোটরে এদের বাসস্থান। নিরাপদ মনে হলে একই বাসায় দীর্ঘ সময় কাটিয়ে দেয়। থাকে জোড়ায় জোড়ায়। এরা নিশাচর হলেও খুব ভোরে এবং গোধূলি লগ্নে শিকারে বের হয়। কখনো মানুষের কোনো ধরনের অনিষ্ট করে না এরা; বরং কিছুটা উপকারেই আসে। ইঁদুর খেয়ে মানুষের ফসল রক্ষা করে। প্রতিদানে মানুষও এদের আগলে রাখার চেষ্টা করে। এদের মাংস ভক্ষণে অরুচি থাকায় শিকারিরাও এ পাখি শিকার করে না খুব একটা। এত কিছুর পরও ওরা আজ অস্তিত্ব সংকটে। এর প্রধান কারণটি হচ্ছে পরিবেশ বিপর্যয়। খাদ্য সংকটও আরেকটি কারণ। তার ওপর রয়েছে গাছের প্রাকৃতিক কোটর স্বল্পতা এবং পুরনো দর-দালান হ্রাস পাওয়াতে ওদের প্রজননে বিঘ্ন ঘটছে ব্যাপকভাবে। এতে চিরচেনা এসব পাখি সাধারণ মানুষের কাছে আজকাল অচেনা হয়ে পড়ছে। সম্প্রতি মুন্সীগঞ্জ জেলায় অমনটি ঘটেছে। এ প্রজাতির একটি পাখি ছয়তলা ভবনে ঢুকে পড়লে ওটাকে অক্ষত অবস্থায় ধরে চিড়িয়াখানায় পাঠানোর উদ্যাগ নেয়া হয়। এ ধরনের প্রবণতা প্রায়ই দেখা যায় আমাদের দেশে। এতে ওই পাখিটা নিরাপদ হতে পারলেও ব্যাপক ক্ষতি হয়ে যায় ওদের পরিবারের। প্রথমত ওর জুড়ি পাখিটার আহাজারি, অবশেষে এলাকা পরিত্যাগ। দ্বিতীয়ত যদি ওই পাখির ডিম অথবা শাবক থেকে থাকে, তাহলে তার পরিণতি কী হতে পারে, তা অনুমেয়। তাই আমাদের প্রত্যাশা, বিরল বন্যপ্রাণী অথবা যে কোনো ধরনের বন্যপ্রাণী ধরা পড়লে ওকে চিড়িয়াখানায় না পাঠিয়ে বরং চিকিৎসা দিয়ে ওর পরিবেশেই ওকে উন্মুক্ত করে দেয়া। এ পাখির বাংলা নাম: লক্ষ্মীপেঁচা, ইংরেজি নাম: বার্ন আউল (Barn Owl), বৈজ্ঞানিক নাম: টাইটো আলবা (Tyto alba), গোত্রের নাম: টাইটোনিদি। এরা লম্বায় ৩৪-৩৫ সেন্টিমিটার। এদের গোলাকৃতি মুখটি ধবধবে সাদা। ঘাড় ও ডানা হলদে-বাদামি। দেহের উপরের দিকটা সোনালি-বাদামি। গলা, পেট, বুক থেকে নিচের দিকে সামান্য চিতি। লম্বা ঠোঁটটি মাংসল সাদা। ঠোঁটের গোড়ার দিকে চেপ্টা মোমের মতো উন্মুক্ত ঝিল্লি মাংসল। চোখ গোলাকৃতির। লেজ খাটো। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। লক্ষ্মীপেঁচার প্রধান খাবার ছোট সরীসৃপ, ইঁদুর, ব্যাঙ, ছোট পাখি ইত্যাদি। জানা যায়, খাদ্য ও বাসস্থান ঠিকঠাক থাকলে বছরের যে কোনো সময় প্রজনন করতে সক্ষম লক্ষ্মীপেঁচা দম্পতি। ডিম পাড়ে ৪-৬টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ৩০-৩৪ দিন। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: মানবকণ্ঠ, 11/01/2013
নীলকণ্ঠ বসন্তবউরি | Blue throated Barbet | Megalaima asiatica
নীলকণ্ঠ বসন্তবউরি | ছবি: ইন্টারনেট গত বসন্তে পাখিটাকে প্রথম দেখি রিকাবী বাজারের পূর্বপাড়ায়। মুন্সীগঞ্জ জেলার মিরকাদিম পৌরসভায় অবস্থিত বাজারটি। খানিকটা ঘনবসতি এলাকা। দালান-কোঠার ফাঁক-ফোকরে যৎসামান্য গাছ-গাছালি রয়েছে ওখানে। সে সুবাদে কিছু পাখ-পাখালির আড্ডাজমে এতদাঞ্চলে। এ পর্যন্ত বেশ ক’প্রজাতির পাখির সাক্ষাৎ পেয়েছি রিকাবী বাজারের আশপাশে। তম্নধ্যে এ পাখিটাই বেশি আমার দৃষ্টি কেড়ে নিতে সক্ষম হয়েছে। আতাগাছের পাতার আড়ালে বসে আতাফল ঠুঁকরিয়ে খাওয়া অবস্থায় ওকে আমি আবিষ্কার করি। আমাকে দেখে ও গাছের শীর্ষ শাখায় অবস্থান নেয়। মুখের খাবার ফেলে দিয়ে নিজেকে আড়াল করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বিষয়টা টের পেয়ে আমিও সটকে পড়ি। পাখিটা দেখতে যেমনি সুন্দর তেমনি গানের গলাও। তারপরও ওরা গায়ক পাখি হিসাবে স্বীকৃতি আদায় করতে পারেনি। গায় করুণ সুরে। তাল-লয়-ছন্দ মেনে গান গায়। ‘পুক্র্ক… পুক্র্ক… পুক্র্ক’ শব্দে ডাকে। পরপর তিনবার ডেকে দম নিয়ে পুনরায় অস্পষ্টভাবে ‘কুক্’ শব্দ করে। এরা একটানা বেশি সময় ধরে ডাকে না। থেমে থেমে ডাকে। ওদের গান শুনে মনে হয় বুঝি ওরা চিরদুঃখী। প্রকৃতপক্ষে তা নয়। সুখ-দুঃখে একই ধরনের সুরে ডাকে। তবে মজাদার বিষয় হচ্ছে ওদের সুর শুনা যায় কিন্তু সহজে দেখা যায় না। পাতার আড়ালে নিজেদেরকে লুকিয়ে রেখে গান গায়। গানের আওয়াজ প্রায় ৬০০-৬৫০ মিটার থেকেও শুনা যায়। এরা আমাদের দেশীয় প্রজাতির পাখি হলেও সহজে দেখা মেলে না, শুধুমাত্র বসন্তকালে এদের দেখা মেলে। এ সময়ে শুধু গ্রামেগঞ্জেই নয়, ঢাকা শহরের বিভিন্ন উদ্যানে প্রবেশ করলেও গাছের শীর্ষশাখা থেকে ওদের ডাক শুনা যায়। এদের গাছে বসার ভঙ্গিটা একটু ব্যতিক্রম। খাড়া হয়ে বসে। একটানা অনেকখানি পথ এরা উড়তে পারে না। উড়ন্ত অবস্থায় ভালো মতো পরখ করলে বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে যায়। মনে হয় উড়তে উড়তে বুঝি মাটিতে পড়ে যাচ্ছে। সুন্দর এ পাখির বাংলা নাম: ‘নীলকণ্ঠ বসন্তবউরি’ ইংরেজি নাম: ‘ব্লু-থ্রোটেড বারবেট,’ (Blue-throated Barbet), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘মেগালাইমা এশিয়াটিকা’ (Megalaima asiatica), গোত্রের নাম: ‘মেগালাইমিদি’। আমাদের দেশে মোট তিন ধরনের বসন্তবউরি দেখা যায়। যথা: বড় বসন্তবউরি, নীলকণ্ঠ বসন্তবউরি, ছোট বসন্তবউরি। এ পাখি লম্বায় ২১-২৩ সেন্টিমিটার। এদের কপাল ও ঘাড় সিঁদুর লাল। মাথার তালু কালচে। ঘাড়ের দু’পাশে দু’টো লালফোটা। মাথার নিচ থেকে গলা পর্যন্ত নীল। বুক থেকে লেজের গোড়া পর্যন্ত হলদেটে সবুজ। লেজের তলার প্রান্তটা নীলচে। পিঠ ঘাস-সবুজ। ডানা বুজানো অবস্থায় সবুজ। নিচে সাদা। ঠোঁট মোটা ত্রিকোনাকৃতির। ঠোঁটের গোড়ায় অল্পক’টি খাঁড়া লোম। চোখের মনি কমলা রঙের বৃত্তদ্বারা আবৃত। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম। সব ধরনের বসন্তবউরিদের প্রিয় খাবারই হচ্ছে ছোট ছোট ফল-ফলাদি। প্রজনন সময় মার্চ থেকে জুলাই। গাছের কোটরে বাসা বাঁধে। পছন্দসই গাছ খুঁজতে ৩-৪দিন সময় লেগে যায়। ডিম পাড়ে ২-৩টি। ডিমের বর্ণ সাদা। স্ত্রী-পুরুষ উভয়ে পালা করে ডিমে তা দেয়। ফুটতে সময় লাগে ১৭-২২ দিন। শাবক উড়তে শেখে ২৫-২৮দিনে। লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 05/10/2012